রবিবার, ৮ মে, ২০১১

রবীন্দ্র জন্মদিন, শিলাইদহ কুঠিবাড়ি এবং আমি


বাঙ্গালীর সকল অস্তিত্বে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ। পরিবর্তিত সময়েও জীবনের সকল আয়োজনে তার প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী, অনিবার্য। আমাদের আধুনিকতা, সভ্যতা সবক্ষেত্রে তার অবদান অনেক। আর বাংলা সাহিত্যে তিনি রবি, কিরণ ছড়িয়েছেন আজন্ম, এখনো। তার শতবর্ষ আগের চিন্তা চেতনা আজও ছন্দময়, বিশ্বয়কর। এই বিশ্বকবির আজ জন্মদিন। দেড়শ’ তম। কোনভাবেই এড়ানো সম্ভব নয় এই মহামানবেরে। তাইতো রবির উদয়ক্ষণে জাগরণ উঠিছে দুই বাংলায়। আজ যেন সব বাঙ্গালীর জন্মদিন, শ্রদ্ধা জানাই তোমায়।
সব বাঙ্গালী আজ উৎসবে মাতোয়ারা। এই দিনটি এলেই আমি ফিরে যাই শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে। মনে পড়ে কুৎসিত সেই ঘটনার কথা। শিহরিত হই এখনও। ঘটনাপঞ্জি ২০০৬ সালের। তখন কাজ করতাম দৈনিক মানবজমিনে। কুষ্টিয়াস্থ স্টাফ রিপোর্টার। মানবজমিনের সাপ্তাহিক প্রকাশনা জনতার চোঁখ-এ ৭মে ছাপা হয় ‘তিন এমপি টেনশনে’ শিরোনামে একটি সংবাদ। সংবাদটিতে ছিল ক্ষমতাসীন বিএনপি দলীয় কুষ্টিয়ার তিন এমপি জনবিচ্ছিন্নতার কারণে সামনের (২০০৭ সালের) নির্বাচন নিয়ে রয়েছেন টেনশনে। এই তিনজনের একজন তৎকালীন জেলা বিএনপির সভাপতি শহীদুল ইসলাম। তিনিই কান্ডটি ঘটান। কেন এমন সংবাদ লেখা হলো কৈফিয়ত চেয়ে প্রকাশ্যে গালিগালাজ করেন। দেখে নেবার হুমকি দেন। রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে তখন চলছিল বিশ্বকবির জন্মদিনে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান। পাশে বসা দু’জন মন্ত্রী, অন্যান্য এমপি, শহীদুলের স্ত্রী। উপস্থিত হাজার হাজার রবীন্দ্র ভক্ত হতভম্ব। হতভম্ব আমিও। তিনি এমন আচরণ করতে পারেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। স্বভাব ও ক্ষমতার মিশেলে এমন হতেই পারে। কিন্তু তিনিই যে এ অনুষ্ঠানের আয়োজক। তিনি অধ্যাপক! সংস্কৃতি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও তিনি। কবির স্মৃতিধন্য কুঠিবাড়িতে জন্ম জয়ন্তী উৎসবে তার এ আচরণ খুবই বেমানান দেখালো। সঙ্গে সঙ্গেই ছি ছি পড়ে গেল। সহকর্মি সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানালো। 
স্কুল জীবন থেকে সাইকেলে করে এই শিলাইদহে আসতাম। তারপর বেড়াতে, অন্যদের দেখাতে এবং পেশাগত কাজে কতবার এখানে এসেছি সে হিসেব করা কঠিন। বিশ্বকবির স্মৃতিধন্য এই কুঠিবাড়ি আমার কাছে তখন একেবারে অচেনা মনে হলো। এই ঘটনার পরও অনেকবার শিলাইদহ গেছি। ওই দুঃস্মৃতি ভেসে উঠেছে ছবির মতো। 
সেদিনের ওই ঘটনার রেশ ছিল আরো দীর্ঘ। ক্ষুব্ধ সংবাদকর্মিরা কুষ্টিয়া ফিরে প্রতিবাদ সভা করে। পরদিন ৯মে সমকাল, যুগান্তরসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক শহীদুলের এই অসভ্যতা নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ওই দিনই এমপি শহীদুল বাদী হয়ে তাকে অস্ত্র দেখিয়ে চাঁদাদাবির মিথ্যা মামলা করেন তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। আমি বাদে বাকী দু’আসামী মুন্সী তরিকুল ইসলাম(সমকাল) ও আল-মামুন সাগর(যুগান্তর)। তাদের অপরাধ হলো আমার পাশে দাড়ানো, এবং শহীদুলের অসভ্যতার প্রতিবাদ করা এবং পত্রিকায় নিউজ করে অসভ্যের মুখোশ খুলে দেয়া। মজার ব্যাপার হলো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার খবর পরদিনের খবরের পাতায় ছাপা হলে আরেকটি মামলা করা হয় আমাদের তিনজনের বিরুদ্ধে। পুলিশ পাঠানো হয় বাসায়। এরপর ঢাকায় পালানোর পথে আমাদের ধরতে পুলিশ ও ছাত্রদলের কর্মিদের দিয়ে প্রহরা বসানো হয় বিভিন্ন পয়েন্টে। মিঠু ভাই (মনজুর এহসান চৌধুরী, সম্পাদক, দৈনিক আন্দোলনের বাজার ও প্রতিনিধি, চ্যানেল আই) এর প্রাইভেট গাড়ীতে করে গ্রাম্য পথে ঢাকায় পৌছাই আমরা। হামলা ও মামলার হুমকিতে ক’দিনের মাথায়ই মিঠু ভাইও আমাদের সঙ্গী হন। বন্ধ করে দেয়া হয় তার পত্রিকা আন্দোলনের বাজার। বন্ধ ছিল ৪৪ দিন। 
বিভিন্ন পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় এই ঘটনার উপর সংবাদ প্রকাশিত হয়। জাতীয় প্রেসক্লাব ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন নানা প্রতিবাদ কর্মসূচী গ্রহন করে। সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, শওকত মাহমুদসহ অন্যরা উদ্যোগ নিলেন কুষ্টিয়ায় গিয়ে সমাবেশ করে আমাদের রেখে আসবেন। আমরা আশার আলো দেখতে পেলাম। কিন্তু খবর পেলাম কুষ্টিয়ায় গেলে হাত পা ভেঙ্গে দেয়া হবে। সমাবেশেই হামলা করা হবে। খবরটি জানালাম ইকবাল ভাইকে। তিনি আমাদের উপর ক্ষেপে গেলেন। বললেন, আমি ভয় পাচ্ছি না। তোমাদের এতো ভয় কিসের। হামলা হলে আমার উপর হবে। আমরা সাহস পেলাম। নির্ধারিত দিন ২৯ মে আমরা কুষ্টিয়া পৌছালাম। আশপাশের বিভিন্ন জেলার সাংবাদিক নেতারা এসেছেন সমাবেশে। আয়োজন করা হয়েছে পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে। ফরিদপুরের সাংবাদিক নেতা লায়েকুজ্জামানের বক্তব্যের পরই শুরু হলো হামলা। অদুরে জেলা বিএনপি অফিসের ভেতর থেকে বের হয়ে ছাত্রদল-যুবদলের ক্যাডাররা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে সমাবেশ স্থলে এসে মারপিট ভাঙচুর শুরু করলো। কপাল ফেটে রক্ত ঝরলো ইকবাল ভাই’র। আহত হলেন ২৩ জন সাংবাদিক। অনেকের মোবাইল, ক্যামেরা ও মোটর সাইকেল ভেঙ্গে ফেলা হলো। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে দেখলো পুলিশ। পরে ঢাকা থেকে নির্দেশ পেয়ে পুলিশের আরেকটি দল গিয়ে আমাদের উদ্ধার করলো। কুষ্টিয়া হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আমাদের নিয়েই ঢাকায় ফিরে আসলেন ইকবাল ভাই।
কুষ্টিয়ায় সাংবাদিক সমাবেশে ইকবাল ভাই’র উপর এই হামলার ঘটনায় দেশে বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। আওয়ামী লীগের এমপি আব্দুর রাজ্জাক এই হামলার বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করেন। এর প্রেক্ষিতে সংসদের বক্তব্য রাখেন হামলাকারি শহীদুল এমপি। তার সেই দম্ভের পক্ষে টেবিল চাপড়িয়ে সমর্থন করেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও। এই দৃশ্য দেখে আমাদের মনে হলো চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আর বোধহয় কুষ্টিয়া ফেরা হবে না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে কুষ্টিয়া পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। ২ মাস ৪দিন পর আমরা কুষ্টিয়া ফিরতে পেরেছিলাম। 
কৃতজ্ঞতা জানাই:
অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, সেই সময়ের বিএনপি দলীয় কুষ্টিয়ার আরেক এমপি। তিনি অ্যামেরিকান দূতাবাসসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মাধ্যমকে আমাদের পক্ষে নানা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। মাইনুল হক খান, উদ্যোগ নিয়ে বিসিডিজেসি থেকে অর্থ বরাদ্দ করে আমাদের ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম, র‌্যারিষ্টার তানিয়া আমির ও সাংবাদিক আব্দুল হান্নান মামলা থেকে আমাদের জামিনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সম্পাদক গোলাম সারোয়ার, মতিউর রহমান, সাংবাদিক কামরুল হাসান, হারুন অর রশিদ, সাইফুল ইসলাম তালুকদারসহ অন্যদের, যারা সংবাদপত্রে লেখনির ঝড় তোলেন। সংবাদিক রাহুল রাহা, যিনি আমাদের নিয়ে এটিএন বাংলায় সংবাদ তুলে ধরেন। জাতীয় প্রেসক্লাব, শহীদুলের ছবি টানিয়ে তাকে নিষিদ্ধ করেন। ইউরোপীয় তিন দেশ বিমানবন্দরে শহীদুলকে কালো তালিকাভুক্ত করে। অ্যামেরিকান এ্যামবেসি, আমেরিকান জার্নালিষ্ট, অ্যামনেস্টি ইন্টান্যাশানালসহ কয়েকশ আন্তর্জাতিক সংস্থা, যারা চাপ সৃষ্টি করেছিলেন আমাদের পক্ষে। আমার স্ত্রী শারমিন আক্তারকে, যিনি সেসমযে গর্ভবতী। এই পরিস্থিতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকেও। আর ধিক্কার জানাই সেসময়ে সমকালে, বর্তমানে কালের কণ্ঠে কর্মরত এক সাংবাদিককে, যিনি কুষ্টিয়া গিয়ে মাত্র ২০ হাজার টাকায় ম্যানেজ হয়ে আমাদের বিপক্ষে সংবাদ লিখেছিলেন।

জাহিদুজ্জামান, সাংবাদিক, চ্যানেল আই।