তৃণমূলে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে, আছে
অনেক সংকট তারপরও বলবো সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিন। করবেন সাংবাদিকতা আর সংসার
চালাবেন অন্য পন্থায় তাহলে কি এই পেশার মানোন্নয়ন হবে? কখনই না। সকল সংকটের মধ্যেও
যারা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছে তাদের বেশিরভাগই সফল হয়েছে, এমনটিই দেখেছি
আমি।
এই আলোচনার শুরুতে দুটি ঘটনার বর্ণনা
দিয়ে শুরু করবো। কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এই আশঙ্কায় চরিত্রগুলো স্পষ্ট করা
না হলেও ঘটনার বর্ণনার মধ্য দিয়ে আলোচনার বিষয়ে সহজে প্রবেশ করা যাবে, এমনটিই
ধারণা করছি।
এক.
মাসখানেক আগে গিয়েছিলাম মিডিয়া নিয়ে কাজ
করে এমন একটি বেসরকারি সংস্থার মতবিনিময় সভায়। বিষয় ছিল স্থানীয় সরকার ও স্থানীয়
সাংবাদিকতা। জনা বিশেক পত্রিকা, টিভি চ্যানেল ও ওয়েব পোর্টালের মফস্বল
সম্পাদক/ন্যাশনাল ডেস্ক প্রধান ছিলেন সেখানে। আলোচনা শুরু হলো। সাংবাদিকতা মহান
পেশা, এর মাধ্যমে তৃণমূলে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আরো
শক্তিশালী হচ্ছে। তথ্য প্রবাহে গতি আসছে। এর জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের
সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও অন্যান্য মাধ্যমের (কমিউনিটি রেডিও) প্রসংসায় পঞ্চমুখ হলেন
বক্তারা। খুবই ভাল লাগলো। মাত্রতো কটা বছর আগে এসেছি জেলা শহর থেকে, এখনো নিজেকে
জেলা পর্যায়ের সাংবাদিকই মনে হয়। হঠাৎ একজন বক্তা বলে ফেললেন, জেলা পর্যায়ে এখনো
এক/দুই জনের বেশি সাংবাদিক নেই যারা ইন্ট্রো (সংবাদের সূচনা) লিখতে পারে।
বক্তব্যটি আসলো এনজিও সংস্থার এক কর্মকর্তার মুখ থেকে। সংস্থাটি দুই বছরেরও বেশি
সময় ধরে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উন্নয়নে সাংবাদিকদের ভূমিকা নিয়ে কাজ করছে। তারা
বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি জেলায় সাংবাদিকদের দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণও দিয়েছে। বিদেশী
অর্থায়নে। এমন বক্তব্য শুনে মাথা গরম হয়ে গেল, যখন কথা বলার সময় পেলাম তখন এর প্রতিবাদ
করলাম। একে একে দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার নাম বলে সেসব জেলার পাঁচের
অধিক সাংবাদিকের নাম বলে গেলাম। বললাম এরা রাজধানীতে কর্মরত সিনিয়র রিপোর্টারদের
সমকক্ষ এবং পেশাদার। পূর্বের বক্তা ফ্লোর নিয়ে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিলেন
এবং তথ্য অজানা থাকার কথা বলে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। কিন্তু বিষয়টি এখানেই শেষ হয়ে যায়
নি। সভায় অংশ নেয়া বেশ ক’জন মফস্বল সম্পাদক জেলা ও উপজেলা
পর্যায়ের সাংবাদিকদের তুমুল ভৎসনা করলেন। তাদের বক্তব্য হলো- যা চাওয়া হয় সেরকম
নিউজ বেশিরভাগ প্রতিনিধিই দিতে পারেন না বা দেন না। একজন বা দুইজন নিউজ লেখেন-ছবি
তোলেন, বাকীরা কপি করে পাঠিয়ে দেন যার যার সংবাদ মাধ্যমে। এমনকি বিশেষভাবে অ্যাসাইনমেন্ট
দিয়েও সে নিউজ পাওয়া যায় না। ফোন করে সময়মতো পাওয়া যায় না। তারা অন্য কাজে ব্যস্ত
থাকে। ইত্যাদি। আমার সঙ্গে কয়েকজন মফস্বল সম্পাদক/ ন্যাশনাল ডেস্ক ইনচার্জ এ মতের
বিরোধীতা করলেন। এক পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের বদলে স্থানীয় সাংবাদিকদের মান নিয়ে
দুই পক্ষে বিভক্ত হয়ে আলোচনা চলতে থাকলো।
দুই.
মাস দুই আগে গিয়েছিলাম একটি টেলিভিশন
চ্যানেলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত একটি মতবিনিময় সভায়। আলোচনার
বিষয়বস্তু ছিল কৃষিতে বাংলাদেশে অগ্রগতি। বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিক, সাবেক ও
বর্তমান কৃষি কর্মকর্তা-বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন একজন মন্ত্রীও। যেহেতু একটি
টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই সভা, তাই আলোচনাতে বারবারই উঠে এলো
কৃষিতে মিডিয়ার ভূমিকা। আর ঘুরেফিরে এলো যে বিশালতায় ছড়িয়ে আছে কৃষি সেই জেলা
পর্যায়ের সাংবাদিকতার মান প্রসঙ্গ। যেমন আলোচনা হলো খাদ্য নিরাপত্তা বলতে জেলা
পর্যায়ের বেশিরভাগ সাংবাদিকই মনে করেন খাদ্যের প্রাপ্যতা। কিন্তু এখানে যে পুষ্টি
ও নিরাপদ খাবার একটি বড় বিষয় সেটি প্রতিবেদনে উঠে আসে না। আলোচনা হলো দু-একজন ছাড়া
জেলা পর্যায়ের সাংবাদিকরা সংবাদের গভীরে যেতে পারেন না। এদের যেমন প্রশিক্ষণের
অভাব রয়েছে তেমনি সংবাদ প্রচার বা প্রকাশের দায়িত্ব যাদের ওপর তারা এসব
গ্রামগঞ্জের খবর বেশি গুরুত্ব দিতে চান না। তাই কৃষি বিষয়ে জেলা পর্যায় থেকে
কাঙ্খিত সাংবাদিকতা হচ্ছে না।
আমার উপলব্ধি, জেলা পর্যায়ের সাংবাদিকতা
অনেক এগিয়েছে। তবে কাঙ্খিত পেশাদারিত্ব এখনো আসেনি। ঘটনা এক. এ যেসব বন্ধু বলেছিলো
বিশেষভাবে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েও জেলা পর্যায় থেকে কাঙ্খিত সংবাদ মিলছে না-তাদের
বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে সামান্যমত পারিশ্রমিক আর প্রশিক্ষণ দেয়া গেলে এ সমস্যার
সমাধান করা সম্ভব। তাদের অনেকই আমার সঙ্গে একমত হয়েছিলেন। কারণ একটু খেয়াল করলেই
দেখতে পাবেন, যেসব সংবাদ মাধ্যম তাদের প্রতিনিধিদের তুলনামূলক বেশি অর্থ প্রদান
করে তারা ভালমানের সংবাদও পাচ্ছেন। আর তৃণমূলের যেসব সাংবাদিক অন্য কোন পেশার সাথে
জড়িত না হয়ে সবসময় এই মহান পেশাকে আঁকড়ে আছেন তারা ওইসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি
হিসেবে নিয়োগও পাচ্ছেন। অর্থাৎ উভয়পক্ষ পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসলে
তৃণমূলে সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটবে, ঘটবে উন্নয়ন। যার সুফল পাবেন জনগন।
শুধু সাংবাদিকতাই নয় যে কোন পেশায়
অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে মূল্যায়ণ করা হয়। আর্থিক অসঙ্গতির কারণে জেলা পর্যায়ের
বেশিরভাগ সাংবাদিকের বাধ্য হয়ে এর পাশাপাশি অন্য একটি পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকতে
দেখা যায়। এতে সাংবাদিকতায় তার খুব বেশি সময় দেয়া হয় না। অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন
করাও হয় না। কিন্তু ঢাকার একজন সাংবাদিক সবসময় যখন এ নিয়েই কাজ করেন তখন তিনি
দ্রুত অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। জেলা পর্যায়ের সাংবাদিকদের জন্য পরামর্শ হলো প্রথমে কষ্ট
হলেও এই পেশায় বেশি সময় দিতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে, তাহলে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা
অর্জন করতে পারবেন। পাবেন ভাল চাকরি।
ঘটনা দুই-এ দেখলাম কৃষি বিষয়ে জেলা
পর্যায় থেকে ভালমানের প্রতিবেদন তৈরি হচ্ছে না। অথচ কৃষির প্রায় সবটুকু্ই রয়েছে
ঢাকার বাইরে। আমার মনে হয় সংবাদ মাধ্যমগুলো সংবাদ প্রচার/প্রকাশের ক্ষেত্রে
বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করলেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। শুধু কৃষিতেই নয় সকল
ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আয়তনে বা জনসংখ্যার বিবেচনায় সারাদেশের তুলনায় ঢাকা খুবই ছোট
হলে সংবাদমাধ্যমে এর কাভারেজ বেশি। দেশের অন্য অংশের সংবাদের গুরুত্ব যারা দিবেন
তাদেরকে অবশ্যই প্রতিনিধিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। তখনই
পেশাদার সাংবাদিক তৈরি হবে জেলা পর্যায়ে।
সবশেষে ঢাকার বাইরে যারা সাংবাদিক নিয়োগ
করেন, তাদের কাছে অনুরোধ থাকবে, আপনার সামর্থ অনুযায়ী প্রয়োজনে কম সংখ্যক সংবাদকর্মী
রাখেন, তবে পেশাদারিত্ব বজায় রাখবেন। সাংবাদিকদের পেশাদার হিসেবে গড়ে তুলুন।
সাংবাদিকদের বলবো অন্য কাজে সময় না দিয়ে পেশায় মনোযোগী হন। অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা
অর্জন করুন। অবশ্যই মর্যাদা পাবেন।