মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০১৫

প্রবারণা পূর্ণিমা রাতে


@ জাহিদুজ্জামান
// সামনের রডের ওপর একদিকে দুই পা দিয়ে বসানো হলো সাত বছরের ছেলে সুভেনিরকে। প্রথমবার এভাবে বসেই চেঁচিয়ে উঠলো। সাহস দিয়ে পড়ে যাবার ভয় দূর করা হলো। এতে কিছুটা স্থির হলেও সে জানালো তার পাদুকা পড়ে যেতে পারে এই দুঃচিন্তার কথা। পেছনের কেরিয়ারে বসেছে আমার স্ত্রী শারমিন। সেও বেশ ভয়ে আছে। এই সাইকেল চালিয়ে উঁচু সড়ক থেকে গ্রাম্য পাকা রাস্তায় নেমে গেলাম। আঁকাবাঁকা এই রাস্তার কোথাও কোন বৈদ্যুতিক বাতি নেই। দু-একটি বাড়ি থেকে বাল্ভের আলোকছটা এসে পড়ছে রাস্তায়। হালকা কুয়াশার আস্তরণে সে আলো টর্চের আলোর মতো মনে হচ্ছে। আর আকাশে জ্বলজ্বল করছিল পূর্ণিমার চাঁদ। আজ প্রবারণা পূর্ণিমা, তা হয়তো জানাই নেই এই গ্রামের কারও। গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন মানুষের বাস না থাকায় প্রবারণার খবর না রাখাই স্বাভাবিক। উঁচু সড়কের ওপরের বিত্তিপাড়া বাজার থেকে নিচে নামলেই আমাদের গ্রাম সোনাইডাঙ্গা। স্বল্প প্রস্থের পাকা সড়ক ধরে এক কিলোমিটার মতো এগিয়ে গেলেই আমাদের বাড়ি। অনেক দিন পর বাইসাইকেলে, তারওপর স্ত্রী-সন্তানকে চড়িয়ে বেশ অস্বস্তিতেই ফেললো আমাকে। মাত্র এক কিলোমিটার রাস্তাই বেশ লম্বা মনে হতে লাগলো। সাইকেলটি আকারে কিছুটা ছোট ছিল। পাদানিতে রেখে ঘোরানোর সময় পা পুরোপুরি সোজা হচ্ছিল না। কিছুটা পথ যেতে না যেতেই পা লেগে আসছিল। তখন পা না চালিয়ে কিছুটা পথ জিরিয়ে নিতে হচ্ছিল। সাইকেল চলছে বাড়ির দিকে। ঈদে ছুটি না মেলায় একদিন পর রাতের বাসে রওয়ানা হই। হিসেবমতে চারটা থেকে সাড়ে চারটার দিকে বিত্তিপাড়া বাজারে পৌঁছানোর কথা। এসময় বাজারে অনেক ভ্যান-রিক্সা পাওয়া যায়। তারপরও পরিচিত ভ্যান-চালক কেরুকে চারটায় আসতে বলে রেখেছিলাম। কিন্তু রাস্তা ফাঁকা থাকায় বাস আড়াইটায় পৌঁছে গেল। তাই বাড়ি যেতে হচ্ছে বাইসাইকেলে। প্রথমের দিকে দু-একবার কাত হয়ে পড়ে যেতে গেলেও সামলে নিয়ে বেশ ভালই চালাচ্ছি সাইকেল। আকাশ পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ঝলমল করলেও রাস্তায় ছিল আলো-আঁধারি। সড়কের ধারের বড়-ছোট গাছ-পালা চাঁদ আড়াল করায় সৃষ্টি হচ্ছিল এই মোহনীয় পরিবেশ। গ্রামের এই পাকা রাস্তার সাথে আমাদের বাড়ি যুক্ত করেছে একশ গজের মতো দৈর্ঘের একটি কাঁচা রাস্তা। এই রাস্তায় নামতেই ঝাঁকিতে আমার স্ত্রীর এক পায়ের সেন্ডেল খুলে গেল। নেমে সেন্ডেল পায়ে দিয়ে আবার উঠে পড়লো কেরিয়ারে। মাত্র একশ গজের মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন এই কাঁচা রাস্তা পেরুতে আমার বেশ বেগ পেতে হলো। পাশে অনেক গাছ-পালা ও বাঁশঝাড় থাকায় এই রাস্তাটুকুর প্রায় অংশেই পৌঁছাতে পারছে না চাঁদের আলো। বাড়িতে সবাই বেভোরে ঘুমোচ্ছিল। অনেক ডাকাডাকির পর উঠে এলো ছোট দুই ভাই। তাদের কাছ থেকে জানা গেল মা গেছে তার মা’র বাড়ি। সাথে আব্বাও। বয়সজনিত অসুস্থতায় নানীর মরণাপন্ন অবস্থা। মা নেই শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। স্ত্রী সন্তানদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে সাইকেল নিয়ে আবার যাচ্ছি বিত্তিপাড়া বাজারের দিকে, ব্যাগেজ আনতে। ঠিক যেন ভ্যানচালকদের মতো খ্যাপ মারছি। তবে, এবার সাথে নিলাম ছোট ভাই ইমনকে। তার সাথেও একটি বাইসাইকেল। দুটো ব্যাগ রাখা আছে মামুনের হোটেলে। মামুন আমার চেয়ে বয়সে বড় হলেও বন্ধুর মতো। স্কুলে এক ক্লাস ওপরে পড়তো। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে কলেজ জীবন পার করা হয়নি তার। বন্ধুদের মধ্যে সে খুবই সাংগঠনিক ও আন্তরিক। তাস ও কেরম বোর্ড খেলায় বেশ পারদর্শী। ছোট ভাইকে নিয়ে পাশাপাশি দুটো সাইকেলে এবার গ্রামের এই পথ সহজ মনে হতে লাগলো। সাইকেল চলছিলও চমৎকার। এখন মনে হচ্ছে সাইকেলটিতে তেল দিয়ে বেশ যত্নেই রাখা হয়। বাড়ি সংযুক্ত কাঁচা রাস্তা শেষে পাঁকা রাস্তায় উঠতেই দেখি একটি খালি ভ্যান। কাছে গিয়ে দেখি এই সেই ভ্যান চালক আমাদের আনতে যাবার কথা ছিল যার। সে আমাকে দেখে চমকে উঠলো। বললো -তোমাদেরই তো আনতে যাচ্ছি।
-বাস অনেক আগেই চলে এসেছে। চারটায় আসার কথা আড়াইটায় বাজারে নামিয়ে দিয়েছে। তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম কিন্তু বন্ধ, তাই জানাতে পারেনি।
ভ্যান-চালক কেরু বললো মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যাবার পর চার্জে লাগানো হয়েছে কিন্তু চালু করতে ভুলে গেছি। যাক কেরুকে আসতে বলে আমরা দুই ভাই সাইকেল চালিয়ে অনেকটা আগেই বাজারে পৌঁছে গেলাম। এবার খালি সাইকেল যেন মটরসাইকেলের মতো চলছিল। এই সাইকেলটিরও একটি ইতিহাস আছে। এটি উজানগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অংকের শিক্ষক সিদ্দিক স্যারের। তিনি আমার প্রিয় শিক্ষক। ১৯৮৮ সাল থেকে যখন আমি স্যারকে দেখেছি তখন থেকেই তাকে সাইকেলে চলতে দেখেছি। তিনি হয়তো তারও অনেক আগে থেকেই সাইকেলে চড়েন। কুষ্টিয়া শহরে স্যারের বাস। ১৫ কিলোমিটার দূরের এই বিত্তিপাড়া বাজারে তিনি সাইকেল রেখে যান। ইংরেজরা এই বাজারের ওপর নীল কুঠি স্থাপন করে এলাকার কৃষকদের শোষণ করতো। সে থেকে এই বাজারকে কুঠি বাজার বলেও ডাকে এলাকার লোকজন। শহর থেকে বাসে এসে নেমে কুঠি বাজার থেকে সাইকেল চালিয়ে এক কিলোমিটার দূরের স্কুলে যাতায়াত করেন। ঈদের ছুটির মধ্যেও সাইকেলটি মামুনের হোটেলে রেখে গেছেন স্যার। স্কুল জীবনে স্যারকে দেখেছি বেশ গতিতে সাইকেল চালাতে। এ ব্যাপারে তিনি বলতেন, দ্রুত যদি নাই গেলাম তাহলে সাইকেল কেন? হেটে গেলেই তো পারি। স্যারের মতো বেশ গতিতে সাইকেল চালিয়ে আমিও দ্রুতই পৌঁছে গেলাম বাজারে। সেখানে তখনও ভ্যানের জন্য অপেক্ষা করছিল তুষার ও তার পরিবার। ঢাকা থেকে বাসে ওঠার কিছুক্ষণ পর আবিস্কার করি আমাদের সামনের সিটে বসে আছে তুষার। তুষার বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ কাজ করে। আমার স্কুল-বন্ধু মশিউরের ছোট ভাই সে। তাকে আমি ছোট ভাই-এর মতোই দেখি। বাসের মধ্যে তুষারকে দেখে বেশ খুশি হয়েছি। ওকে বললাম, তোমার সাথে অনেক দিন দেখা হয়না। বাসের মধ্যে তোমাকে পেয়ে ভালই হলো। অনেক গল্প করা যাবে। তুষার যে লাইনের সিটে বসে আছে ওই লাইনের একজন যাত্রী বাস মিস করেছে। নিজের সিট ছেড়ে আমি ওই সিটে বসেই আসলাম। সারা পথ ওর সাথে ঢাকা-কুষ্টিয়ার অনেক গল্পই হলো। তুষারদের বাড়ি বাখইল গ্রামে। সেখানে যেতে তাকেও নামতে হয়েছে বিত্তিপাড়া বাজারে। আমরা যখন বাজারে এসে নামি তখন আড়াইটা বাজে। নেমেই দেখি সাইকেল নিয়ে ছুটে আসলো মামুন। বাজারে চুরি ডাকাতি ঠেকাতে পালাক্রমে পাহারা দেয় দোকান মালিকরা। এদিন ছিল মামুনের পালা। রাতে কোন বাস এসে থামলেই ছুটে যাচ্ছিল সে। পরিচিত কেউ এলো কি-না দেখার জন্য। তার কাছেই পাওয়া গিয়েছিল সিদ্দিক স্যারের সাইকেলটি। আমাদের জন্য হোটেল খুলে বসতে দিলো সে। রাতে বানানো গরম গরম মিষ্টি খেতে দিলো। মিষ্টি খাওয়াতে গিয়ে হঠাৎ দেখি সুভেনির নেই। দেখি বাইরে এসে আইপডে ঝলমলে পূর্ণিমার ছবি তুলছে সে। এদিক সেদিক লোকজন পাঠিয়ে অনেক খোঁজাখুজি করেও যখন কোন ভ্যান যোগাড় করা গেল না, তখন সেই বুদ্ধি দিলো সাইকেলে যা, একটা অ্যাডভেঞ্চারও হয়ে যাবে। আমিও রাজি। আমার কিন্তু বেশ মজাই লেগেছে। ভ্যান-চালক কেরু এসে পৌঁছালে তুষারদের তুলে দিয়ে ব্যাগেজ নিয়ে সিদ্দিক স্যারের সাইকেল চেপে আবার চলে গেলাম বাড়ি।

মানুষ করা দরকার

কী স্বভাবে হয় যে মানুষ?
জানো নাকি ও ভাই পুরুষ
মানুষে মানুষে মানুষের গুণ
ভালভাবে আজ প্রচারের দরকার। 

লোভ-লালসায় ভোলে যে সব
তারে কি মানুষ বলা যায়?
অর্থ চাই, সুখ চাই, কী করে পাই
মজা খুঁজি আমি ও ভাই, 
আমারে যে মানুষ করা দরকার। 
মানুষের গুণ প্রচারের দরকার। 

আমি মহান, আমি ভাল, আমি সবার সেরা
আমি ছাড়া মানুষ আছে কেবা?
এই ভাবনা ভাবে যেবা
তারে কি মানুষ বলা যায়?
নামানুষকে মানুষ করা দরকার। 
মানুষের গুণ প্রচারের দরকার।
-জাহিদুজ্জামান

সোমবার, ১৫ জুন, ২০১৫

আষাঢ়স্য

নয় শুধু প্রথম দিনের আষাঢ়
বর্ষার সব বৃষ্টি ছিল আমার

আষাঢ়

১. ওহে বারি, ঝরিছো যে ভারি
ভুললে নাকি এতো জৈ্যষ্ঠ
আষাঢ়ের ঢের দু'দিন দেরি


২.
ভিজতাম আমি ভিজে যেত মন
এখনো মন চায়, পারে না শরীর
হঠাৎ ভিজে গেলেও ভেজে না যেন