জাহিদুজ্জামান
গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস বলেছিলেন ‘এক নদীতে দুই বার স্নান করা যায় না’। এ কথায় তিনি চলমান জীবনের মর্ম তুলে ধরেছিলেন। তার মতে নদীর প্রবাহ চলমান তাই একবারই ওই পানি দিয়ে স্নান করা যায়। যদি কোন কারণে কোন কালে ওই পানি আবার ফিরে আসে ওই মানুষকে সেসময় পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু দূষিত-দুর্গন্ধ হয়ে গেলে সে পানি নদীর হোক বা পুকুরের হোক তা বাতিল হয়ে যায়। তাতে আর স্নান করতে নামে না কেউ। তেমনটি হয়েছে সাংবাদিকদের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের সম্পর্ক। ক্ষমতাকালে এতো বেশি অত্যাচার করেছে যে তারা দূষিত-পঁচা পানির মতো হয়ে গেছে। বাতিল হয়ে গেছে। আর নদীর মতো প্রবহমাণ হতে পারছে না। সাংবাদিকরাও ওই দুর্গন্ধের পানিতে নামছে না।
বিএনপি আমলে সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অনেক নজির আছে। তার মধ্যে থেকে আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা তুলে ধরছি। ঘটনা ২০০৬ সালের। তখন কাজ করতাম দৈনিক মানবজমিন পত্রিকা ও আরটিভিতে। আরটিভির কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি ও মানবজমিন পত্রিকায় কর্মরত ছিলাম স্টাফ রিপোর্টার, কুষ্টিয়া হিসেবে। লিখতাম হাসান জাহিদ নামে। সামনে ছিলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ কারণে নির্বাচন বিষয়ক সংবাদ হচ্ছিল পত্রিকায়। সেই সময়ে ২০০৬ সালের ৭মে মানবজমিন পত্রিকায় আমার বাইলাইনে ছাপা হয় ‘তিন এমপি টেনশনে’ শিরোনামে একটি সংবাদ। সংবাদটিতে ছিল ক্ষমতাসীন বিএনপি দলীয় কুষ্টিয়ার তিন এমপি জনবিচ্ছিন্নতার কারণে নির্বাচন নিয়ে রয়েছেন টেনশনে। এই তিনজনের একজন তৎকালীন জেলা বিএনপির সভাপতি শহীদুল ইসলাম। টেনশনের প্রমাণ দিয়ে তিনি এক মহা কাণ্ড ঘটিয়ে বসেন। কেন এমন সংবাদ লেখা হলো কৈফিয়ত চেয়ে প্রকাশ্যে দীর্ঘক্ষণ গালিগালাজ করেন আমাকে। দেখে নেবার হুমকি দেন। ঘটনাস্থল ছিল শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি। সেখানে তখন চলছিল বিশ্বকবির জন্মদিনে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান। পাশে বসা দু’জন মন্ত্রী, অন্যান্য এমপি, শহীদুলের স্ত্রী। উপস্থিত হাজার হাজার রবীন্দ্রভক্ত। সবাই হতভম্ব। হতভম্ব আমিও। তিনি এমন আচরণ করতে পারেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। স্বভাব ও ক্ষমতার মিশেলে এমন হতেই পারে। কিন্তু তিনিই যে এ অনুষ্ঠানের আয়োজক। সংস্কৃতি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও তিনি। কবির স্মৃতিধন্য কুঠিবাড়িতে জয়ন্তী উৎসবে তার এ আচরণ খুবই বেমানান ঠেকলো। সঙ্গে সঙ্গেই ছি! ছি! পড়ে গেল। সহকর্মী সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানালো।
স্কুল জীবন থেকে সাইকেলে করে শিলাইদহে যেতাম। বেড়াতে, অন্যদের দেখাতে এবং পেশাগত কাজে কতবার গেছি সে হিসেব কষা কঠিন। বিশ্বকবির স্মৃতিধন্য এই কুঠিবাড়ি আমার কাছে তখন একেবারে অচেনা মনে হলো। এই ঘটনার পরও অনেকবার শিলাইদহ গেছি। ওই কষ্টস্মৃতি ভেসে উঠেছে ছবির মতো।
সেদিনের ওই ঘটনার রেশ ছিল আরো দীর্ঘ। ক্ষুব্ধ সংবাদকর্মীরা কুষ্টিয়া ফিরে প্রতিবাদ সভা করে। পরদিন ৯মে সমকাল, যুগান্তরসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক শহীদুলের এই অসভ্যতা নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ওই দিনই এমপি শহীদুল বাদী হয়ে মিথ্যা মামলা করেন তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। আমি জাহিদুজ্জামান (হাসান জাহিদ) প্রধান আসামি। বাকী দু’আসামী আরো দুজন সহকর্মী-সাংবাদিক। অভিযোগ, সরকারদলীয় ক্ষমতাধর এই সাংসদের কাছে অস্ত্র দেখিয়ে চাঁদাদাবি। এই মিথ্যা মামলার খবর পরদিনের খবরের পাতায় ছাপা হলে মিথ্যা অভিযোগ এনে আরারো মামলা দায়ের করা হয় তিনজনের বিরুদ্ধে। পুলিশ পাঠানো হয় বাসায়। এরপর ঢাকায় পালানোর পথে আমাদের ধরতে পুলিশ ও ছাত্রদলের কর্মিদের দিয়ে প্রহরা বসানো হয় বিভিন্ন পয়েন্টে। গ্রাম্য পথ দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কোনমতে ঢাকায় পৌঁছাই আমরা।
বিভিন্ন পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় এই ঘটনার উপর সংবাদ প্রকাশিত হয়। জাতীয় প্রেসক্লাব ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহন করে। সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, শওকত মাহমুদসহ অন্যরা এক পর্যায়ে উদ্যোগ নিলেন কুষ্টিয়ায় গিয়ে সমাবেশ করে আমাদের রেখে আসবেন। আমরা আশার আলো দেখতে পেলাম। কিন্তু খবর পেলাম কুষ্টিয়ায় গেলে হাত পা ভেঙ্গে দেয়া হবে। সমাবেশেই হামলা করা হবে। খবরটি জানালাম ইকবাল ভাইকে। তিনি আমাদের উপর ক্ষেপে গেলেন। বললেন, আমি ভয় পাচ্ছি না। তোমাদের এতো ভয় কিসের। হামলা হলে আমার উপর হবে। আমরা সাহস পেলাম। নির্ধারিত দিন ২৯ মে আমরা কুষ্টিয়া পৌঁছালাম। সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে।
এর পরের ঘটনা সিনেমার দৃশ্যের মতো। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সমাবেশ গুড়িয়ে দেয় তাদের পাণ্ডারা। আর তা দাঁড়িয়ে দেখতে বাধ্য হন উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু সেদিন পুলিশ সদস্যরা ঘোরের মধ্যে ছিলেন বোধহয়! বুঝতে পারেন নি বাস্তবে ঘটছে...না, দেখছেন কোন সিনেমার দৃশ্য। তারাও দাড়িয়েই ছিলেন।
সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর সঙ্গে সেদিনের সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন ওমর ফারুক, ফরাজী আজমল হোসেন, প্রয়াত সাইফুল ইসলাম তালুকদারসহ সাংবাদিক নেতাদের ছোট্ট একটি দল। ক্ষমতাসীন বিএনপি দলীয় সাংসদ ও নেতাকর্মীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আসেন আশপাশের ৭টি জেলার সর্বস্তরের সাংবাদিকরা। কিন্তু সমাবেশ শুরু হতে না হতেই পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া ছাত্রদল ও যুবদলের ক্যাডাররা হামলে পড়ে। পাশে অবস্থিত জেলা বিএনপি অফিসের ভেতর থেকে বের হয়ে তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে সমাবেশস্থলে এসে মারপিট-ভাঙচুর শুরু করে। কপাল ফেটে রক্ত ঝরে ইকবাল সোবহান চৌধুরীর। কম-বেশি আহত হন ২৩ জন সাংবাদিক। অনেকের মোবাইল, ক্যামেরা ও মোটর সাইকেল ভেঙ্গে ফেলা হয়। হামলার আশঙ্কায় সমাবেশ স্থলের চারপাশে আগেই অনেক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। কিন্তু সরকারি দলের এই হামলা দাড়িয়ে দেখতে হয়েছিল তাদের। মাঝে মধ্যে দু-একবার বাঁশি দিয়েছিল। পরে অবশ্য ঢাকা থেকে নির্দেশ পেয়ে পুলিশের আরেকটি দল গিয়ে আক্রান্তদের উদ্ধার করে। ততক্ষণে পণ্ড সমাবেশ। সাংবাদিক নেতারা আশ্রয় নেন পাবালিক লাইব্রেরির পাঠ কক্ষে। এরপরেও সমাবেশ শেষ করতে চেয়েছিলেন সাংবাদিক নেতারা, সাপোর্ট দেয়নি পুলিশ। পুলিশ পাহারায় মিছিল করে স্থান ত্যাগ করেন তারা। কুষ্টিয়া হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আমাদের সঙ্গে নিয়েই ঢাকায় ফিরে যান নেতারা। সে সময় প্রশাসনে দলীয়করণ এতোটা প্রভাব বিস্তার করেছিল যে দেশে-বিদেশে আলোচিত ওই ঘটনায় ইকবাল সোবহান চৌধুরী বাদী হয়ে মামলা দিলেও তা নেয়নি পুলিশ।
এমন অনেক সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা আছে বিএনপি আমলে। ঘটেছে হত্যাকাণ্ড। অন্য আমলে যে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন হয়নি তা বলছি না। কিন্তু সেসময়ের চিত্র সব নির্যাতনকে হার মানায়। আর একথাও বলা যায় যে সেসব সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলো না। দলীয় ও রাষ্ট্রীয় দায়ও ছিলো। আমার সঙ্গে ওই ঘটনার পর যা ঘটেছিল তা জানলে অবশ্যই আমার সঙ্গে একমত হবেন। ওই ঘটনার পর বিএনপির দলীয় প্যাডে টেলিভিশন ও পত্রিকা অফিসে চিঠি দিয়ে আমাদের চাকরিচ্যূত করার চেষ্টা করেছিল। আর জাতীয় সংসদে যখন এ নিয়ে আলোচনা উঠেছিল তখন শহিদুল ইসলাম এমপির সাফাই বক্তব্যের পক্ষে টেবিল চাপড়ে সমর্থন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
এরকম অনেক নির্যাতন, অন্যায়, দুর্নীতি বিএনপিকে শেষ করে দিয়েছে। তারা এখন পঁচা পানির মতো। পুকুরে থাক আর মরা নদীতে থাক আছে বাতিলের খাতায়। অন্যদিকে সাংবাদিকবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার প্রবহমাণ নদীর মতো উচ্ছ্বল। সাংবাদিকদের বিপদে পাশে দাড়ান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেন আর্থিক সহায়তাও। তাই নতুন প্রজন্মের সাংবাদিক যারা তাদের বেশিরভাগের সমর্থন এদিকেই যাচ্ছে। আমার সাংবাদিকতার শুরুর দিকে দেখেছি সাংবাদিকদের মধ্যে বিএনপি সমর্থকদের সংখ্যাই ছিলো সিংহভাগ। কিন্তু এখন চিত্র উল্টে গেছে, প্রগতির পক্ষে চলছে সাংবাদিকতা। চাওয়া এই প্রবাহ অব্যাহত থাক।
লেখক: জাহিদুজ্জামান, সাংবাদিক