সোমবার, ১৯ অক্টোবর, ২০০৯

দারিদ্র দূরীকরণের ঘোষনা কতদুর পৌছায় ?

আবু বকর সিদ্দীক, সম্পাদক-দৈনিক সময়ের কাগজ
কুষ্টিয়ার বাজারে চিনির দাম ৬০ টাকা। পিঁয়াজ, রসুন, বেগুন সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। সবই কৃষকের উৎপাদিত পণ্য। কিন্তু তার মালিক আর কৃষক না। হাত ঘুরে তা এখন মজুদদারের গুদামে, মালিক টাকাওয়ালা মহাজন। এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে তাদের গভীর সখ্যতা। রাজনীতির নিয়ন্ত্রনকর্তা। ভোট ও মিছিলে তারা টাকা দেয়। লোক দেয়। মামলা ও হামলায় সহযোগিতা করে। আইনপ্রণেতা, গণতন্ত্রের ছেলে মেয়েরা নতজানু। মজুদদারের ইশারায় তারা হাসেন, কাঁদেন এবং বিদেশ প্রমোদে যান। আয়েশ করে মজুদদার ব্যবসা করেন। রাস্ট্রের অস্ত্রসহ পুলিশ পাহারা দেন। র‌্যাব, আর্মি , বিডিয়ার নিরাপত্তা দেন। দ্রব্যমূল্যের দাম তার কাছে নস্যি। যত বাড়বে, বাড়াতে পারবে ততই সুখ। কৃষক জনসংখ্যার ৯০ ভাগ। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, সচিবালয় এবং রাজধানীর পাঁচ তারা হোটেলগুলোতে কৃষি কাজ হয় না। দেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের শরীর জুড়ে কৃষকের ছড়াছড়ি। কৃষি আবাদ। গণতন্ত্রের প্রথম ও শেষ ধাপজুড়ে কৃষকের প্রাধাণ্য থাকার কথা। নির্ভেজাল শ্রম বিকিয়ে মাটির গর্ভ থেকে তুলে আনে ফসল। এখানে ফাঁকি বা ঘুষ চলে না। নির্দিষ্ট সময়ের আগেও কোন ফসল ঘরে আসে না। ইচ্ছে করলেই জুন ফাইনালে রাতারাতি কোন কাজ শেষ করা যায় না। সময়, শ্রম, বিনিয়োগ ও পরিচর্যার মাধ্যমেই কৃষক উৎপাদন করে। সন-ানের মমতায় যে ফসল বড় করে, ঘরে আনে তা দুদিনের মাথায় চলে যায়। ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। সময়ের প্রয়োজনে সে যখন আর তা কিনতে যায় তখন দাম বেড়ে যায় কয়েকগুন। কোটি কোটি কৃষক, মুখ বন্ধ। আবু ইসহাকের জোঁক গল্পের সেই কৃষকের সঙ্গে সবাই মহাজনি সুদের কবলে জিম্মি। বেশীরভাগ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন না হলে সেখানে সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব নয়। এই সহজ কথা বোঝার জন্য বিদেশী ডক্টরেট ডিগ্রী এবং আপাদমস-ক রাজনীতিবিদ হতে হয় না। ৯০ ভাগ মানুষের উন্নয়ন চিন-া বাদ দিয়ে এদেশে চলছে ১০ ভাগ নিয়ে টানাটানি। সেখানেও সুবিধা ভোগ করছে হাজারে কয়েকজন। সব মিলে সারা দেশের এক হাজার বা দুই হাজার লোক সম্পদের পাহাড় গড়ছে, কোটি কোটি লোক বঞ্চিত হচ্ছে। সবই হচ্ছে রাজনৈতিক দুবৃত্তায়নের জালে। গণতন্ত্রের নামে এ দেশে লুটপাটতন্ত্র চলছে দীর্ঘ দিন। চুক্তি করে আওয়ামীলীগ-বিএনপি লিজ নিচ্ছে। কোটি কোটি কৃষকের মুখে টোনা বাঁধা। যেভাবে কৃষক গরুর মুখে বাঁধে। সব দেখবে, বুঝবে বলতে পারবে না কিছু। গণতন্ত্র এদের মুখে আছে। মাথায় ও অন্তরে প্রতিহিংসা। শোষণ করার লিপ্সা। কথিত সুশীলদের নিয়ে এরা দারিদ্র্য বিমোচনের শপথ নেয়। বিলাসবহুল আলোঝলমলে চীনমৈত্রী সম্মেলনে গরিবদের জন্য আহা করে। সামনে বসে থাকে মেদবহুল ব্যবসায়ী, সমাজের সুশীল। কৃষকের জন্য ( দেশের গরিব মানুষ) কান্না করে। টিসু বক্সের শেষ টিসুটি নিয়ে নাকের সর্দি ও চোখের পানি পরিস্কার করে। তৈলাক্ত টিভি ক্যামেরার পুজিবাদী মালিক সে দৃশ্য কৃষককে দেখায়। মাটির মতই গলে যায় কৃষকের মন। মঞ্চের নেতা-নেত্রীরা চশমার ফাঁক দিয়ে ডিজিটাল প্যানারোমা ব্যানার, ফেস্টুন ও নামী হোটেলের দামী ফাস্টফুড দেখেন। তখন কুষ্টিয়ার গোস্বামী দুর্গাপুর ইউনিয়নের দরিদ্য কৃষক খবির চিৎকার করে আকাশ কাঁপায়। আট বছরের শিশুপুত্র সেলিমকে সে ঠিকমত খেতে দিতে পারেনি। নিজে অসুস্থ, বউও। সংসারে টানাটানি। একটি এনজিওর কিস্তি না দিতে পারায় হারিয়েছে দোচালা টিনের ঘরটি। অভুক্ত, অপুষ্ট সেলিম ঠান্ডা জ্বরে শ্বাস নিতে পারছে না। অনেক কষ্টে টেনে এনেছে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের বারান্দায়। ৪০ এর ঘরে খবিরের বয়স। ভাঙাচোরা চেহারা। মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখে মুখে ছেলেকে বাঁচানোর আর্তি। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল, আশে-পাশের মানুষ নির্বিকার। পড়ন্ত বিকেলে ১৬ অক্টোবর আমি গিয়েছিলাম বন্ধুবর আকাশকে দেখতে। সংবাদকর্মি, অসুস্থ। বেরিয়ে যাওয়ার সময় এমারজেন্সির সামনে একজন পিতার কান্না আটকে দিল। ফ্যাল ফ্যাল করে সেলিম তাকিয়ে আছে। হাসপাতালের ট্রলির উপর, হাড্ডিসার একটি শিশু। ছুটে ছুটে ডাক্তার, নার্স আর হাসপাতালের কর্মচারীদের পায়ে ধরছে পিতা। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য চড়া সুদে ৫০০ টাকা এনেছে। খবিরও অসুস্থ। কাঁশছে। কিন্তু ছেলের জন্য উদগ্রীব। বার বার ছুটে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরছে। ছেলেটি নির্বিকার। সবগুলো টিভি চ্যানেলে প্রধানমন্ত্রীর দারিদ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনার অনুষ্ঠান লাইভ দেখাচ্ছে। সুন্দর শাড়ীতে তাকে মানিয়েছে, সুশোভিত চীন-মৈত্রী সম্মেলন(বর্তমান নাম বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র) কেন্দ্রে তিনি দেশ থেকে দারিদ্য দূর করার যুদ্ধ ঘোষনা করছেন।

কোন মন্তব্য নেই: