শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০০৯

শংকরদিয়া : যে গ্রামের অর্ধেকই ঘরজামাই

সাজ্জাদ রানা, কুষ্টিয়া প্রতিনিধি, দৈনিক সমকাল ::
প্রথমদিকে ঘরজামাইরা নানা ভাবে অপদস্ত অপমানিত হলেও এখন আর সেদিন নেই। এখন ঘরজামাইদের উপর চোখ রাঙ্গিয়ে কথা বলার কোন সুযোগ নেই। আগের চেয়ে ঘরজামাইরা অনেক বেশি সু-সংগঠিত। সামনে ইউপি নির্বাচনে ঘরজামাইদের পক্ষ থেকে একজন মেম্বার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। এ জন্য ঘরজামাই ফোরাম নামে একটি কমিটি গঠন করা হবে। সব খরচও ফোরাম বহন করবে। তবে এখনও ঘরজামাইদের নানা সমস্যা মোকাবেলা করে বসবাস করতে হচ্ছে। এভাবেই ঘরজামাইদের নানা সমস্যা ও পরিকল্পনার কথা বলছিলেন আরেক ঘরজামাই বসির উদ্দিন। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার গোস্বামী দূর্গাপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম শংকরদিয়া। কাগজে কলমে নাম শংকরদিয়া হলেও সে নামটি এখন সবাই ভুলতে বসেছে। এখন গ্রামটির নাম হয়ে গেছে ‘ ঘরজামাই’। বর্তমানে ১১০ জন ঘরজামাই গ্রামটিতে বাস করছে। ওয়ার্ডটির ৩ হাজার ভোটারের মধ্যে সাড়ে ৫শ’ ভোটারই ঘরজামাই ও তাদের পরিবার পরিজন। সবমিলিয়ে শংকরদিয়াসহ আশেপাশের গ্রামে ঘরজামাইদের প্রভাব কোন অংশেই কম নয়। বরং দিনকে দিন তা বাড়ছে ।
প্রথম ঘরজামাই
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে শংকরদিয়া গ্রামের প্রথম ঘরজামাই তফেজ মন্ডল। বর্তমানে তার বয়স ৮৯ বছর। শরীরে আর তেমন বল শক্তি নেই। তবে নিজের বিয়ের কথা মনে আছে এখনো। কথা হলে তিনি জানান, আজ থেকে আনুমানিক ৭৩ বছর আগের কথা। তখন আমার বয়স ১৬ বছর। আমার বাড়ি ছিল পাশাপাশি গ্রামে। আমার চাচারা এ গ্রামে বাস করতেন। তাদের সুত্র ধরেই শংকরদিয়া গ্রামের জিন্নাত আলীর এক মাত্র সন্তান ছামেয়া খাতুনকে বিয়ে করেন। জিন্নাত আলীর বাড়িতেই থাকা শুরু করেন তফেজ। জিন্নাত আলী মারা যাবার পর তার প্রচুর সম্পত্তির মালিক হন তফেজ। তফেজ ৯ ছেলে ও ৩ মেয়ে সন্তানের জনক। ছেলে মেয়েরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। তফেজ মন্ডলের মত আরেক ঘরজামাই আছালত মন্ডল (৭০)। শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তি পেয়ে এখন অনেক টাকার মালিক আছালত।
ঘরজামাই ১১০
তফেজ মন্ডলকে দিয়ে শুরু হলেও ঘরজামাইয়ের সংখ্যা এখন ১১০। আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম ছাড়াও দেশের অন্য জেলার বাসিন্দারা এখানে কাজ করতে এসে আর ফিরে যায়নি। বিয়ে করে থেকে গেছেন ঘরজামাই। তবে ঘরজামাইদের বেশির ভাগই কৃষি শ্রমিক। কেউ কেউ ভ্যান নসিমন চালান। আবার অনেকেই ছোট ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছেন। তবে যারা শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তি বাগিয়ে নিয়েছেন তারা বেশ আরামেই আছেন। কৃষি শ্রমিক ঘরজামাই কাসেম আলী জানান, তার বাড়ি চুয়াডাঙ্গা জেলায়। এ গ্রামে কাজ করতে এসে বিয়ে করেন। আর ফিরে যাননি এলাকায়। মাঠে কাজ করে যা হাজিরা পায় তা দিয়ে কোন মতে চলে যায়। চা দোকানী ঘরজামাই বসির জানান, ঘরজামাই থাকাকে অনেকেই ভাল চোখে দেখে না। নিজের বাবার কোন জমি জায়গা ছিল না। তাই বিয়ের পর এ গ্রাম থেকে আর যায়নি। ঘরজামাই আবদার আলী, ঈসা সর্দ্দার সবাই প্রায় একই রকম কথা বলেন। একই পরিবারে একাধিক ঘরজামাইও রয়েছে। আমেনা ও রহিমা দুই বোন। তাদের স্বামীরা ঘরজামাই থাকেন। খোঁজনিয়ে জানাগেছে, একই এলাকার মহর আলী ঘটক বিয়ে করেন শংকরদিয়া গ্রামের জের আলীর মেয়েকে। মহর আলীর একমাত্র মেয়ের জামাই মসলেম উদ্দিন ঘরজামাই থাকেন। আবার মসলেম উদ্দিনের জামাইও আলম ঘরজামাই। আলম পরিচয় গোপন করে মসলেমের মেয়েকে বিয়ে করে কয়েক বছর আগে। পরে সবাই জানতে পারে সে সন্ত্রাসী। বর্তমানে সে জেলে রয়েছে।
সু-সংগঠিত ঘরজামাইরা
ঘরজামাইরা একসময় নানাভাবে নিগৃহিত হলেও এখন দিন বদলে গেছে। ঘরজামাইয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকাই তাদের শক্তিও আগের থেকে অনেক বেশি। আগে বাইরে বের হলে নানাজনে নানা মন্তব্য করত। তবে জামাইদের এখন সবাই সমীহ করে চলে। গ্রামের ঘরজামাই আনিস জানান, এ গ্রামে ঘরজামাইয়ের সংখ্যা অনেক। ঘরজামাইদেও কোন সংগঠন না থাকলেও অচিরেই একটি কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটির মাধ্যমে এলাকার বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজে অংশ নেবে সবাই এছাড়া সামনে ইউপি নির্বাচনে একজন প্রার্থী থাকবে আমাদের। সবাই মিলে আমরা কাজ করতে চাই। এলাকার মেম্বার জাকির হোসেন লালন বলেন, শংকরদিয়া গ্রামে ঘরজামাইয়ের সংখ্যা যে ভাবে বাড়ছে তাতে করে পুরো গ্রামই তাদের দখলে চলে যাবে। ঘরজামাইদের মধ্যে কোন বিভেদ নেই। তারা বেশ আরামেই বাস করছে এখানে।
যে কারণে ঘরজামাই বাড়ছে
এলাকার পরিবেশ অনেক শান্ত। সন্ত্রাসীদের কোন ঝামেলা নেই। রাস্তাঘাট যোগাযোগ ব্যবস্থারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সারাবছরই কাজ থাকে এ এলাকার লোকজনের হাতে। তাই বাইরের লোকজন এসে শংকরদিয়া গ্রাম দেখে মুগ্ধ হন। তাই অনেকেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আর ফিরে যান নি। এছাড়া পরিবারের লোকজনের সাথে ঝগড়া বিবাদ করে এসেও অনেকেই বিয়ে করে ঘরজামাই আছেন। ঘরজামাই বেড়ে চলার পিছনে এসব যুক্তি দেখালেন শংকরদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, গ্রামটিতে ঘরজামাই বেড়েই চলেছে। এতে করে সুবিধার পাশাপশি বেশ কিছু অসুবিধাও হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। ঘরজামাই রবিউল জানান, শংকরদিয়া গ্রামটি এমনিতেই সুন্দর। এখানে সারা বছরই কাজ থাকে। ঘরজামাইদের বেশির ভাগই অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষ করেন। খোঁজনিয়ে দেখাগেছে, ঘরজামাইদের বেশির ভাগই দরিদ্র। দারিদ্রতার কারনেও ঘরজামাইয়ের সংখ্যা বাড়ছে বলে স্থানীয় অনেকেই মনে করেন। এ গ্রামটিতে ঘরজামাই খুবই সাধারন একটি ব্যাপার।

কোন মন্তব্য নেই: