মঙ্গলবার, ২৩ জুন, ২০০৯

সাংস্কৃতিক রাজধানী কুষ্টিয়ায় কবি নজরুলের স্মৃতিময় দিনগুলি


বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় প্রায় সমানভাবে বিচরনের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। সর্বগুনে গুনান্বিত এই কালজয়ী মহাপুরুষের জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গে হলেও রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগ্রহন ও বৈবাহিকসূত্রে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা, ময়মনসিংহ ও কুষ্টিয়াসহ তৎকালীন পূর্ববঙ্গের অনেক অঞ্চলেই তার পদচারনা ছিল উল্লেখ করার মত।বাংলাদেশের প্রান্তবর্তী সাংস্কৃতিক রাজধানীখ্যাত এই কুষ্টিয়া জেলাতেও তিনি তার জীবনের বেশ কিছু দিন অতিবাহিত করেছেন। যদিও তা একেবারেই খোদ কুষ্টিয়াতেই অনালোচিত এবং শুধুমাত্র স্মৃতি-শ্র“তিতেই আবদ্ধ। এমনকি ধারনা করা যেতে পারে কুষ্টিয়ায় প্রায় সিংহভাগ মানুষই জানেন যে কবি নজরুলের পদধুলি পড়েছিল এই সাংস্কৃতিক রাজধানী কুষ্টিয়াতে। এই বিষয়ে কুষ্টিয়ার বিশিষ্ট জ্ঞানতাপস, আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষক, প্রাবন্ধিক, ড. আবুল আহসান চৌধুরী ‘কুষ্টিয়ায় নজরুল’ শিরোনামে একটি নিবদ্ধে কুষ্টিয়ায় নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলির কথা অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন যা থেকে আমরা কুষ্টিয়ায় অবস্থানকালীন সময়ে কবি নজরুলের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সহ অন্যান্য কর্মকান্ডের বিষয়গুলি সম্পর্কে সুন্দরভাবে জানতে পারি। কমরেড মুজাফফর আহমেদ, কবি আজিজুর রহমান, সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায়, সাহিত্যিক কুমারেশ ঘোষ, বিপ্লবী সুধীর স্যানাল, কুষ্টিয়ার বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংস্কৃতসেবী দেবেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, কবি ও গীতিকার ডাঃ আব্দুর রহমানসহ আরও অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তিবর্গ কুষ্টিয়ায় নজরুলের অবস্থানকালীন সময়ে তার কর্মকান্ডের সাক্ষী এবং এ ব্যাপারে তারা দালিলিক প্রমানও উপস্থাপন করেছেন। মূলতঃ কবি নজরুল কুষ্টিয়ায় প্রথম এসেছিলেন রাজনৈতিক কারনে। কবি নজরুলের ঘনিষ্ট সুহৃদ ও রাজনৈতিক সহযোদ্ধা হেমন্ত সরকার ছিলেন একজন খ্যাতিসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সংগঠক, বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য ও চীপ হুইপ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক। মূলতঃ তারই আমন্ত্রনে এবং বেঙ্গল পেজান্টস্ এ্যান্ড ওয়াকার্স পার্টির সাংগঠনিক কাজে ১৯২৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে কৃষ্ণনগর থেকে কবি নজরুল কুষ্টিয়ায় সপরিবারে আসেন। তিনি যতবার কুষ্টিয়ায় এসেছেন প্রত্যেকবারই আমলাপাড়াতে অবস্থিত বন্ধ হেমন্ত সরকারের ‘ডিউকট’ নামের বাসাতে অবস্থান করতেন। এই সময়ে কবি নজরুল সাম্যবাদী নেতা ফিলিপ স্প্যাট ও হেমন্ত সরকারের সঙ্গে বেঙ্গল পেজান্টস্ এ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টির সাংগাঠনিক কাজে নিজেকে ব্যাস্ত রেখেছিলেন। এই সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও তিনি সময় ব্যায় করতেন। গান শেখানো, আবৃত্তি চর্চার মাধ্যমে তিনি কুষ্টিয়ার সংস্কৃতিমনা তরুনদের মধ্যে যথেষ্ঠ উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করেন। রাজনৈতিক কর্মকান্ড না থাকলে ডিউকট লজে দেশাত্ববোধক গানের আসর বসত। ১৯২৮ সালে তৎকালীন যতীন্দ্রমোহন হল তথা আজকের পরিমল থিয়েটার মঞ্চে বেঙ্গল পেজান্টস্ এ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই উপলক্ষে নজরুলের আগমন ঘটে কুষ্টিয়াতে। সাম্যবাদী নেতা কমরেড মুজাফফর আহমেদ,হেমন্ত সরকার, বৃটেনের সাম্যবাদী নেতা ফিলিপ স্প্যট ও কবি নজরুলের উপস্থিতিতে সম্মেলন সাফল্যমন্ডিত হয়। উক্ত সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কমরেড মুজাফফর আহমেদ। সম্মেলনে ফিলিপ স্প্যট ভারতের স্বাধীনতার দাবীতে বক্তৃতা করেন। কবি নজরুলের ‘চাষী ধর কষে লাঙ্গল’ গানটি সম্মেলনে উপস্থিত প্রায় এক হাজার প্রতিনিধিদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি করে। ১৯২৯ সালেও নজরুল ইসলাম কুষ্টিয়ায় এসেছিলেন এক কৃষক সম্মেলন উপলক্ষে এবং এক সংবর্ধনা সভায় যোগ দিতে। এই কৃষক সম্মেলনের উদ্যেক্তা ছিলেন হেমন্ত কুমার সরকার। হেমন্ত কুমার সরকারের আমন্ত্রনে নজরুল পুত্র বুলবুল ও দু মাসের শিশু সানি (সব্যসাচী)- সহ নজরুলের স্ত্রী প্রমিলা এবং শাশুড়ী গিরিবালা দেবীও তার (হেমন্ত বাবু) আমলাপাড়ার বাড়ীতে বেড়াতে এসেছিলেন। উক্ত সম্মেলনে বঙ্গীয় কৃষকলীগ নামে কৃষকদের একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। কমিউনিষ্ট ইন্টারন্যাশনালের ষষ্ঠ কংগ্রেসে দু’ শ্রেনীর ভিত্তিতে ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পেজান্টস্ পার্টি গড়ার বিরুদ্ধে উক্ত সম্মেলনে সমালোচনা করা হয়। মূলতঃ এই সংগঠনকে এক শ্রেনীর ভিত্তিতে দাঁড় করানোর প্রয়াসের অংশ হিসেবে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের মধ্যমনি ও মূল আকর্ষন ছিল কবি নজরুল।তার দরাজ কন্ঠে গান ও কবিতা এই অনুষ্ঠানের দর্শকদের মাতিয়ে তুলেছিলো। ‘‘কৃষকদের গান’’, “জেলেদের গান” ও “শ্রমিকদের গান”- এইসব গানের মধ্যে শ্রমিকদের গানটি নজরুল পূনরাবৃত্তি করে কয়েকবার গেয়েছিল এই কারনেই যে ঐ অনুষ্ঠানে মোহিনী মিলের শ্রমিকরাই ছিল সংখ্যগরিষ্ঠ। ১৯২৯ সালে এই কৃষক সম্মেলনে এসে নজরুল গড়াই নদীর অপর পারে সবান্ধব হাটশ হরিপুর গিয়েছিলেন। হেমন্ত কুমার সরকার ও “জাগরন” সম্পাদক নিশিকান্ত পাত্রকে নিয়ে কবি প্রথমে উঠেছিলেন কংগ্রেস ও খেলাফত কর্মী ও তার পূর্ব পরিচিত বন্ধু রেজওয়ান আলী খান চৌধুরী সাহেবের বাড়ীতে। হাটশ হরিপুরে নজরুল কবি আজিজুর রহমান, তারপূর্ব পরিচিত খান সাহেব হারুনুর রশীদ ও গোলাম রহমান সাহেবের বাড়ীতেও গিয়েছিলেন। রমজান মাসের সেই বিকালে কবি নদীর ধারে শিকারও করতে গিয়েছিলেন। একটি হরিয়াল ও একটি ঘুঘুও শিকার করেছিলেন তিনি। সেই দিন সন্ধ্যায় শ্রোতাদের অনুরোধে ‘আসে বসন্ত ফুলবনে’, ‘আমার চোখর ইশারায় ডাক দিলে’, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’, ‘চল চল চল’, ‘বাজলো কিরে ভোরের সানাই’ সহ আরও বেশ কয়েকটি গান গেয়েছিলেন কবি নজরুল। তারাবির নামাজের কারনে পরের দিন আবারও গানের আসর বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরের দিন কাক ডাকা ভোরেই তাকে সবান্ধব চলে যেতে হয়। ধারনা করা হয়, সম্ভাব্য গ্রেফতার এড়ানোর জন্যই তাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। হাটশ হরিপুরে কবির এই আগমনের বিষয়টি কবি আজিজুর রহমানের স্মৃতিচারনার তথ্য থেকে পাওয়া যায়। ১৯২৯ সালেই কবি নজরুলকে কুষ্টিয়া মিউনিসিপ্যালিটির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এসই সময় বিশিষ্ট আইনজীবী তারাপদ মজুমদার ছিলেন কুষ্টিয়া মিউনিসিপ্যালিটির স্বনামধন্য চেয়ারম্যান। স্থানীয় যতীন্দ্রমোহন হলে (বর্তমানে পরিমল থিয়েটার হল) এই সংবর্ধনার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তারাপদ মজুমদার। এই সংবর্ধনার কাজে শহরের গোপীপদ চট্টোপাধ্যায়, মাহাতাব উদ্দিন আহমেদ, ফজলুল বারী চৌধুরী, হারুনুর রশীদ, গোলাম রহমান, নিশিকান্ত পাত্র, তাজ উদ্দীন আহমেদ (তাজু মিয়া) প্রমুখ ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন।
কুমারখালীতেও কবি নজরুলেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই সংবর্ধনা সভার উদ্যেক্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যসেবী ডাঃ আব্দুর রহমান, কাঙাল হরিনাথের জ্ঞাতি-ভ্রাতুস্পুত্র ভোলানাথ মজুমদার, আব্দুল গনি, গোঁড়া মৈত্র। কুমারখালী যোগেন্দ্রনাথ এম.ই স্কুল প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত এই সংবর্ধনা সভায় নজরুল ইসলাম তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন এবং ‘জাতের নামে হাতের মোয়া’ গানটি গেয়েছিলেন। সেদিন কবি নজরুলকে কাছে পেয়ে কুমারখালীর সর্বস্তরের মানুষ ধন্য হয়েছিল। তিনি কাঙাল হরিনাথের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার কাঙাল কুটিরেও উপস্থিত হয়েছিলেন। এই সাংস্কৃতিক রাজধানী কুষ্টিয়াতে কবি নজরুল বিভিন্ন সময়ে এসেছেন, অবস্থান করেছেন, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহন করেছেন। তাই কুষ্টিয়া জেলা কবি নজরুলের কাছে এক স্মৃতিবিজড়িত স্থান।কুষ্টিয়ায় অবস্থানকালীন সময়ে নজরুল কোন সাহিত্যচর্চা করেননি একথা ভাবা অবান্তর। কিন্তু তথ্য এবং রচনাস্থা নের উল্লেখ না থাকায় কুষ্টিয়ায় অবস্থানকালীন সময়ে তার রচনা সনাক্ত করার সুযোগ থেকে আমরা কুষ্টিয়াবাসী বঞ্চিত। তবে কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত জাগরণ (১৯২১) পত্রিকায় কবি নজরুলের কিছু রচনা প্রকাশিত হয়েছে। আমরা কুষ্টিয়াবাসী ধন্য।
আমাদের গর্ব ও অহংকার এই কারনে যে, কবি নজরুলের পদধুলি পড়েছে এই কুষ্টিয়াতে। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় এই ইতিহাস কুষ্টিয়াবাসীর অধিকাংশই জানেন না এবং তা কালক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। আজকে কুষ্টিয়াবাসী হিসেবে আমাদের দাবী কুমিল্লা, ময়মনসিংহ জেলায় যেমনিভাবে কবি নজরুলের জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকী সরকারী পর্যায়ে উদযাপন করা হয় ঠিক তেমনিভাবে কবি নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত এই কুষ্টিয়া জেলাতেও সরকারী পর্যায়ে তার জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন করা হউক।
এব্যাপারে জেলা প্রশাসন যদি কুষ্টিয়ায় কবি নজরুলের কুষ্টিয়ায় অবস্থানকালীন সময়ের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়কে অবহিত করে তাহলে অচিরেই সরকারী পর্যায়ে কুষ্টিয়ায় কবি নজরুলের জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপিত হবে। আর এটি যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে কুষ্টিয়াবাসী হিসেবে আমাদের গর্ব ও অহংকার আরও বেড়ে যাবে।বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ও বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী যদি সরকারী পর্যায়ে কুষ্টিয়াতে উদযাপিত হয় তাহলে সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে কুষ্টিয়ার মান মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পাবে।
তথ্য সংকেতঃ
[এ্যাড: শামিম উল হাসান সম্পাদিতঃ চির উন্নত শির। ড. আবুল আহসান চৌধুরী ঃ কুষ্টিয়ায় নজরুল। কুষ্টিয়া, ১১ই জোষ্ঠ্য, ১৪১৪ বাংলা; পৃষ্ঠাঃ ৫-১২]

কোন মন্তব্য নেই: