রবিবার, ৫ জুলাই, ২০০৯

দক্ষিন-পশ্চিমে পরিবেশ বিপর্যয়, মরুময়তা শুরু



হাসান জাহিদ : ফারাক্কার অশুভ প্রভাবে দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোতে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। এখানকার জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশবিদরা যে আশংকার কথা বলে চেচামেচি করে আসছিলেন সেই মরুকরন শুরু হয়েছে এ এলাকায়। আষাঢ়ের ১৪তম দিনে এসে কুষ্টিয়া অঞ্চলে বৃষ্টির দেখা মেলে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হয়না যে এখন বর্ষাকাল চলছে। প্রতিদিনই যেন বাড়ছে গরমের মাত্রা। প্রচন্ড তাপদাহে মানুষের জীবনযাত্রা বিষিয়ে উঠেছে। পদ্মা গড়াই এর তপ্ত বালুচর থেকে আসা লু হাওয়া এ অঞ্চলে মরুর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আগুনের ভল্গা এসে মানুষের শরীরের উপরিত্বক পুড়িয়ে দিচ্ছে। কোথাও যেন শীতল বাতাস নেই। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরায় বিঘœ ঘটছে। মাঠের ফসল পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। বারাবার কৃত্তিম সেচ দিয়েও জমি তৈরী করতে পারছেন না কৃষকরা। সেচ দেবার পরক্ষনেই জমি শুকিয়ে যাচ্ছে। কৃষকদের ক্ষেতে কাজ করা কষ্টদায়ক হয়ে পড়েছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতির উপর অত্যাচার অর্থাৎ প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি রোধ করার করেনেই এ ধরনের বিপর্যয় ঘটছে।
পানি বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ারুল করীম বলেন, পার্শ্ববর্তি দেশ ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মান করে গঙ্গা নদীর স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্থ করেছে। যে কারনে এদেশের অন্যতম স্রোতশ্বিনী নদী পদ্মার আজ মরনদশা। খোদ এ বর্ষা মৌসুমেও নদীর যৌবন নেই। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মার পানির প্রবাহ সর্বনিু পর্যায়ে নেমে এসেছে। এবারও গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি অনুযায়ী পানি আসেনি। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার ভারত সরকারের সাথে এ পানি চুক্তি সম্পাদন করে। চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুম অর্থাৎ জানুয়ারী থেকে মে মাস পর্যন্ত ভারত কয়েকটি টাইম ফ্রেমে ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার কিউসেফ পানি সরবরাহ করবে বাংলাদেশকে। চুক্তির ৯ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পদ্মা বাদে আরো মোট ৫৩টি অভিন্ন নদীর পানি সমবন্টনের চুক্তি করার কথা। কিন্ত ভারত ওই চুক্তি না করে ৫৩টি নদীর পানিতো বটেই বরং চুক্তির প্রতি বিদ্রুপ করে গঙ্গার পানিও প্রত্যাহার করেছে। ভারত মোট ৫৪টি নদ-নদীর পানি ইচ্ছামতো প্রত্যাহার করে চলেছে। আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এসেছে। মানুষ ভেবেছিল এবার চুক্তি অনুযায়ী পানি পাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে তার উল্টো। পানির প্রবাহ সবচেয়ে নিুে পৌছেছে। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি এসেও এবার হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১৫টি গার্ডারের মধ্যে ৫টি মাত্র পানির মধ্যে। বাকী ১০টি বালিচরে দাড়িয়ে। যা এক সময় ছিল কল্পনারও অতীত। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নীচে দাড়িয়ে কথা হলো পাকসী এলাকার বৃদ্ধ কৃষক আব্দুর রহমানের সাথে। তিনি বলেন, আমরা যৌবনে দেখেছি পদ্মায় সারাবছর স্রোত থাকতো। বর্ষা মৌসুমে কয়েক মাইল দুর থেকেই এর হু হু শব্দ শোনা যেত। আর এখন কি দিয়ে কি হয়ে গেল কোন সময়েই পদ্মায় স্রোত দেখি না। পদ্মার ভয়ঙ্কর রূপ দেখে আমাদের যুবক বয়সেও ভয় লাগতো। এখন বৃদ্ধ বয়সেও পদ্মাকে আর ভয় করেনা। এই যে দেখছেন না ব্রিজের নীচে জমি চাষ দিচ্ছি। বর্ষা মৌসুমে এমন ভাবার ফুরসত ছিলনা আমাদের। পদ্মায় এখন শুধু বালিচরই বৃদ্ধি পায়নি, পেয়েছে চাষযোগ্য জমির পরিমানও। আর পদ্মার পানি প্রবাহ খালের মতো হয়ে গেছে। যেখানে ব্রিজের নিরাপত্তার কারনে স্রোতের ভয়ে নদীতে বালি ফেলা হতো, আজ সেখানে ব্রিজের নীচে জমা বালি উত্তোলন করছে ব্যবসায়ীরা।
চুক্তি মোতাবেক পানি সরবরাহ করার কথা ৩০ মে পর্যন্ত। চুক্তি যখন করা হয় তখন ধরে নেয়া হয়েছিল মে মাসের পর থেকে বর্ষা শুরু হবে। তখন এমনিতেই নদ-নদীতে বান ডাকবে। কিন্তু বছরের পর বছর অব্যাহত পানি প্রত্যাহারের ফলে দেশের দক্ষিনাঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। পদ্মার বুকে ধু ধু বালু চর দিন দিন বি¯তৃত হচ্ছে। বাড়ছে উষ্ণতা। কমে আসছে শীতকালের দৈর্ঘ্য। ভারী বর্ষন না থাকায় বর্ষাকালই দেখা যাচ্ছে না। আর শুষ্ককাল শুরুর আগেই শুরু হয়ে যাচ্ছে খরা মৌসুম। দ্রুত কমে যায় পদ্মার পানি। এতে করে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প। পদ্মায় পানির উচ্চতা যতো নীচে নেমেছে ততই কমেছে এ প্রকল্পের কার্যকারিতা। দক্ষিনের জেলাগুলোর কৃষকের ৪ লাখ ৮৮ হাজার একর জমি সেচের আওতায় এনে জিকে প্রকল্প শুরু হলেও বর্তমানে সেচের আওতা কমতে কমতে ১ লাখ হেক্টরের নীচে চলে এসেছে। ১৫ আষাঢ় পর্যন্ত খরিপ-১ মৌসুমে কৃষকরা এ প্রকল্প থেকে ঠিকমতো পানি পায়নি। এ এলাকার কৃষকরা নির্ভরশীল ছিল ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর। সাধারনত: বর্ষাকাল শুরু হওয়ায় আষাঢ়ের ১৬ তারিখ থেকে খরিপ-২ মৌসুমে জিকে প্রকল্পে ভরপুর পানি থাকে। কিন্তু এবার পদ্মায় পানির উচ্চতা কম থাকায় জিকে প্রকল্পের ইনটেক চ্যানেলে পর্যাপ্ত পানি আসছে না। বারবার চ্যানেলটি খনন করা হলেও বালি এসে আবার বন্ধ করে দিচ্ছে। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় অবস্থিত জিকে প্রকল্পের তিনটি পাম্প মেশিনের মধ্যে বর্তমানে দু’টি চালু আছে। আরেকটির মেরামত চলছে। কিন্তু এ দু’টিও পানির অভাবে চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। একটি পাম্প চলছে অধিকাংশ সময়।
পানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. আনোয়ারুল করীম জানান, ফারাক্কার অশুভ প্রভাবে একদিকে আমাদের পদ্মা নদীতে পানি কমে গেছে। যে কারনে বেড়েছে বালি চর। এতে উত্তপ্ত হচ্ছে পরিবেশ। অন্যদিকে নদীতে পানি না থাকায় কৃষকেরা ভূ-গর্ভ থেকে পানি তুলে চাষ করার পানিয় স্তর আরো নীচে নেমে যাচ্ছে। আর পদ্মায় পানি না থাকায় শুকিয়ে গেছে আমাদের খাল বিল। খাল বিলে পানি না থাকায় পানি বাষ্প হয়ে উঠছে না। সৃষ্টি হচ্ছে না মেঘ। যে কারনে দেখা মিলছে না বৃষ্টির। এতে করে গাছ গা-ছাড়া মরে যাচ্ছে। কৃষকেরা ফসল পাচ্ছে না। পরিবেশের ইকো সিষ্টেম (ভারসাম্য) বিনষ্ট হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে সুন্দরবনের। বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ মরে যাচ্ছে। এতে করে ঘটছে আইলা, সিডরের মতো বিপর্যয়।
ড. করীম বলেন, আমরা বিভিন্ন সেমিনার করে সরকারের সাথে আলোচনা করেছি। কিন্তু এতোদিন কেউ আমাদের কথা আমলে নেয়নি। আমরা বলেছি মরুময়তা ধেয়ে আসছে। ধেয়ে আসছে লবন পানি। আজ আমরা বলছি দক্ষিনের জেলাগুলোতে মরুকরন পুরোপুরি শুরু হয়ে গেছে। লবনাক্ততা মধুমতি নদীতে অর্থাৎ ফরিদপুর পর্যন্ত পৌছে গেছে। নদী উপচে আগে পলি আসতো, আমাদের কৃষি জমির উর্বরা শক্তি বাড়তো। এখন আসছে বালি আর লবনাক্ততা। এখনি উদ্যোগ নেয়া না হলে দক্ষিনের কৃষি ধ্বংস হয়ে যাবে। কুষ্টিয়া শহরের উপকণ্ঠ দিয়ে প্রবাহমান পদ্মার প্রধান শাখা গড়াইর উৎস মুখ বন্ধ রেখে বারবার খনন করা হয়েছে। যে কারনে বালি এসে আবার ভরাট হয়ে গেছে। আবার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়াই খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এবারও উদ্যোগ ব্যর্থ হবে। এরজন্য আগে প্রয়োজন পদ্মা খনন। তার আগে প্রয়োজন পানি প্রবাহের নিশ্বয়তা দেয়া।
গত ১২ জুন খুলনার নর্দার্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌথ নদী কমিশন পানির উপর এক সেমিনার আয়োজন করে। সেমিনারে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী টি এ খান, প্রকোৗশলী গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, ঢাকা ওয়াসার সাবেক এমডি ড. আজহারুল হক, খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, বিভাগীয় কমিশনার ইউনুসুর রহমান, গড়াই এরিয়া ওয়াটার পার্টানারশীগের চেযারম্যান প্রফেসর ড. আনোয়ারুল করীম বক্তব্য রাখেন। সেমিনারে সবাই ঐকমত্য হন যে, মানুষের অবিবেচনার কারনেই পরিবেশের এ বিপর্যয়। দক্ষিনের এ মরুকরণ সমস্যাকে জাতীয়ভাবে দেখতে হবে। অনতিবিলম্বে ভারতসহ অন্যান্য দেশের সাুথে ফারাক্কা ও টিপাই মুখ বাধ নিয়ে আলোচনা করে সমাধান করতে হবে। প্রয়োজনে বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্থ অন্যান্য দেশসমুহকে সাথে নিয়ে আমাদের মিটিং করতে হবে। গড়াই মুখ খুলে রাখার স্থায়ী ব্যবস্তা করতে হবে। উন্নত দেশসমূহ সমুদ্রের মধ্যে বোমা বানাচ্ছে এগুলি বন্ধ করতে হবে।
না হলে যে মরুকরণ শুরু হয়েছে তার হাত থেকে বাচতে অচিয়েরই দক্ষিনের মানুষকে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে আন্দোলনে নামতে হবে। কারন পানি না থাকলে এখানে জীব-বৈচিত্র নিশ্চিহ্ন হবে।

কোন মন্তব্য নেই: