বুধবার, ১৫ জুলাই, ২০০৯

পশ্চিমাঞ্চলের ৫৮৯ কিলোমিটার সীমান্ত গলিয়ে বানের জলের মত ঢুকছে মাদক দ্রব্য

লায়েকুজ্জামান : দক্ষিনে সুন্দরবন থেকে উত্তরে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে পদ্মা নদীর পাড়। ৫শ’ ৮৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত। মাদক চোরাকারবারীদের অভয়ারন্য। বানের জলের মত ঢুকছে নানা পদের মাদক। সীমান্ত এলাকার মানুষ জানিয়েছে বিডিআর বিদ্রোহের পর মাদক প্রবেশের গতি বেড়েছে বহুগুন। সীমান্ত পেরিয়ে বিশেষভাবে তৈরি যানে মাদকের চালান প্রবেশ করছে দেশের ভেতরে, ঢুকছে রাজধানী শহর ঢাকাতে। মাদকের নীল ছোবলে এখন আক্রান্ত হয়ে পড়ছে স্কুলের কোমলমতি কিশোররাও এমন ভয়াবহ খবর পাওয়া গেছে কুষ্টিয়া, যশোর এবং মাগুরা জেলাতে। দেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে নেশার নতুন সংযোজন টিডি জেসিক ইনজেকশন। ভারতে ঘোড়া অচেন করার কাজে ব্যাবহার হওয়া ওই ইনজেকশন এখন দেশের যুব সমাজের কাছে এক মরন নেশা।
পশ্চিমাঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ এবং কুষ্টিয়া জেলার সঙ্গে ভারতের বিশাল সীমান্ত। ওই সকল জেলার মধ্যে সবচে বেশী এলাকা জুড়ে সীমান্ত সাতক্ষীরা জেলার সঙ্গে। সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত ২৩৮ কিলোমিটার। সুন্দরবনের জলসীমা থেকে স্থল ভাগ পর্যন্ত প্রায় গোটা সীমান্ত এলাকা জুড়েই চলে মাদকের চোরাকারবার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশাল ওই সীমান্তের প্রায় সর্বত্র দিয়েই মাদক প্রবেশ করলেও বড় আকারে মাদকের চালান আসে ১৫ টি পয়েন্ট দিয়ে। জলসীমা দিয়ে দেশে মাদক প্রবেশের সবচে বড় পয়েন্ট সুন্দরবন। ভারতের কালিন্দি নদী হয়ে নৌপথে বাংলাদেশের রায়মঙ্গল নদী দিয়ে মাদক প্রবেশ করে। ওই মাদক দ্রব্যের একটি অংশ থাকে সাতক্ষীরায় বাকী অংশ নৌ পথে আসে খুলনায়। খুলনা থেকে বাগেরহাট হয়ে সে নেশা দ্রব্য ছড়িয়ে পড়ে দেশের দক্ষিনের জেলাগুলোতে। সাতক্ষীরা সীমান্তে দিয়ে মাদক প্রবেশের অন্যান্য পয়েন্টগুলো হচ্ছে বসন্তপুর, দেবহাটা, থানজিয়া, টাউন শ্রীপুর, ভোমরা, বৈচারী, তুষখালী, তলইগাছা, কাকডাংগা, কেরাগাছী, ভাটিয়ারী, মাদরা, চানদা, হিজলদী এবং চান্দুরিয়া।
নদী পথে মাদক পাচারের জন্য ব্যাবহার করা হয় বিশেষভাবে নির্মিত নৌযান। মাছ ধরা নৌকার আদলে তৈরি ওই সকল নৌযানের তলদেশে বিশেষভাবে মাদক রাখার কক্ষ নির্মান করা হয়েছে। সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে বেশী আসে ফেনসিডিল, হেরোইন এবং ভারতীয় এইট পিএম মদ।
সীমান্ত প্রহরীসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিভিন্ন সময়ে কুষ্টিয়া এবং সাতক্ষীরা এলাকায় যে নেশাদ্রব্য আটক হয়েছে সে হিসেবে দেখা যায়, গত এক বছরে এখানে কেবলমাত্র ফেনসিডিল আটক হয়েছে প্রায় এক কোটি বোতল। জানা যায়, পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের পর কুষ্টিয়া সীমান্ত দিয়ে মাদক প্রবেশের পরিমান আরো বেড়েছে এবং বর্তমান সময়েও সে ধারাও অব্যহত রয়েছে। গত এক মাসে কুষ্টিয়ায় আটক হয়েছে ১০ হাজার বোতল ফেনসিডিল।
যশোরের সীমান্ত এলাকা ১৭৫ কিলোমিটার। প্রায় পুরো সীমান্ত দিয়েই প্রবেশ করে মাদক দ্রব্য। এ সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করে ফেনসিডিল, হোরেইন, ভারতীয় বিভিন্ন মদ, এবং বিভিন্ন ধরনের যৌনউত্তেজক ট্যাবলেট। পরিমল, টেন হর্স, ইডিগার এবং বস নামের যৌন উত্তেজক ট্যাবলেটে সয়লাব এ এলাকার হাট বাজার। যশোর সীমান্ত দিয়ে আসা মাদক দ্রব্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌছে দিতে এখানকার মাদক ব্যাবসায়ীরা ট্রাক, মাইক্রোবাস এবং প্রাইভেট কার কেটে তাদের মত করে যান তৈরি করে নিয়েছে। মাইক্রোবাস এবং প্রাইভেট কারের দরজা কেটে ভেতরে ফাকা জায়গা করে সেখানে রাখা হয় ফেনসিডিলের বোতল এবং হেরোইন। গাড়ীর নীচে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ খোল সেখানে রাখা হয় মাদক দ্রব্য। যশোর সীমান্তের বাশগাছা, রঘুনাথপুর, তাজগুলাট, গোগা রুদ্রপুর, হাদিপুর, চৌগাছা, পুড়াপাড়া, কাশিপুর, শিকড়ি পয়েন্ট দিয়ে এখন অবাধে মাদকের চোরাচালান পার হয়।
যশোর সীমান্ত দিয়ে অন্যান্য মাদক আসলেও যশোর চোরচালানের জগতে নামকরা হেরোইনের জন্য। দেশব্যাপি পরিচিত যশোরের এক চোরাচালানী নিয়ন্ত্রন করে এখানকার হেরোইন ব্যাবসা। জানা যায়, রাজধানী শহরে বিক্রিত হেরোইনের প্রায় আশি ভাগের সরবরাহ আসে যশোরের ওই চোরাকারবারীর মাধ্যমে। হেরোইনের নামে বিক্রি করা ভারত থেকে আনা সাদা ওই পাউডার যশোরে বিক্রি হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা কেজি দূরে। ঢাকাতে বিক্রয় মুল্য দশ লাখ টাকা কেজি।
মেহেরপুরে সীমান্ত এলাকা ১৮ কিলোমিটার। মেহেরপুরে বেশীর ভাগ মাদক প্রবেশ করে গাংনী সীমান্ত দিয়ে। এখানে মাদক প্রবেশের বড় দু’টি পয়েন্ট তেতুলবাড়িয়া এবং নাজিরা কোলা।
ঝিনাইদহ জেলায় সীমান্ত ৩৪ কিলোমিটার। মহেশপুর, কোটচাদপুর এবং মহেশপুরের বাগদা সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করে মাদকের বিশাল বিশাল চালান। মাদকের ওই সকল চালান চোরাচালানীরা এনে জমা করে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে। সেখান থেকে পাইকারীভাবে ক্রয় করে আনে অন্যান্য জেলার মাদক ব্যবসায়ীরা।
কুষ্টিয়া জেলার সীমান্ত ৪৬ কিলোমিটার, এর মধ্যে ১৮ কিলোমিটার জুড়ে ভারত কাটাঁ তারের বেড়া নির্মান করেছে বাকী ২৮ কিলোমিটার উন্মুক্ত। কুষ্টিয়ার ধর্মদহ থেকে চিলমারী পর্যন্ত সীমান্ত এলাকায় রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের মুনসীগঞ্ছ, টোটাপাড়া, সলিমের চর, চরপাড়া, এবং চিলমারী ইউনিয়নের চিলমারী এবং উদয় নগর পয়েন্টে মাদকের চোরাচালান হয় অবাধে-প্রকাশ্যে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার এ সীমান্ত এলাকাটি পদ্মা নদী বেষ্টিত। দৌলতপুর উপজেলার চিলমারী ইউনিয়নের দু’পাশ দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা নদী, মাঝে বালু চর, যাতায়াত ব্যবস্থা একেবারে দুর্গম। এ সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন দেশে প্রবেশ করে লাখ লাখ বোতল ফেনসিডিল। পদ্ম্ নদী দিয়ে ওই সকল ফেনসিডিল সহজে প্রবেশ করে ঢাকার মাদক বাজারে।
চুয়াডাঙ্গা জেলার ৭৮ কিলোমিটার সীমান্ত জুড়েই মাদকের কারবার চলছে দেদারসে। বিডিআর বিদ্রোহের পর মাদক চোরাকারবারের যে অবাধগতি শুরু হয়েছিলো এখনো সে রকমই আছে বলে জানালেন দর্শনার সাধারন মানুষ। দর্শনায় এখন এক বোতল ফেনসিডিল পাওয়া যায় ১শ টাকায়। এক বছর আগে ছিলো প্রায় তিনগুন। সে সময় কড়াকড়ি ছিলো সীমান্তে। চুয়াডাঙ্গা জেলার ধোপাখালী, চ্যাং মারী, উথলী, দশর্না, দামুড়হুদা, কার্পাস ডাঙ্গী, বেনী নগর, জয়নগর এবং নিমতলা সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন দেশে প্রবেশ করে মাদকের বড় বড় চালান। চুয়াডাঙ্গা জেলার ওই সকল সীমান্ত গলিয়ে আসছে টিডি জেসিক নামের এক ধরনের ইনজেকশন। নেশার ওই নতুন উপকরন দ্রত ছড়িয়ে পড়ছে দেশের অভ্যন্তরে, লুফে নিচ্ছে যুব সমাজ। বিশাল এই সীমান্ত এলাকা গলিয়ে প্রতিদিন দেশে প্রবেশ করছে নানা কিসিমের মাদক দ্রব্য। ছিটে ফোট ধরা পড়ছে দেশের অভ্যন্তরে, আর সিংহ ভাগ পৌছে যাচ্ছে নেশাখোরদের হাতে।

কোন মন্তব্য নেই: