সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০০৯

মহানাম যজ্ঞের সংকীর্তন শিল্পীদের রাগমালা



- মীর জাহিদ
আমরা যখন আসরে সংগীত পরিবেশ করি তখন সামনে বসে থাকা ভক্ত শ্রোতাদেরকে ঈশ্বর মনে করি। কীর্ত্তন দলের শিল্পীদের মুখে এমন বক্তব্য শোনার পর থেকে তাদের প্রতি আমার বিশেষভাবে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এযাবত যতগুলি কীর্ত্তন আসর শুনেছি ততই নতুনভাবে তাদের মধ্য থেকে গুনী শিল্পী আবিস্কার করেছি। বাংলাদেশে প্রায় সাতশত কীর্ত্তন দল নিয়মিত সারাদেশে বিভিন্ন মন্দিরে কীর্ত্তন গানের আসর করে থাকে। কুষ্টিয়া শহরের আশেপাশে প্রায় কুড়িটি মন্দিরে মহানামযজ্ঞ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে আমি যে, একজন কীর্ত্তন গানের একনিষ্ঠশ্রোতা একথাটি বিভিন্ন মন্দিরের আয়োজকেরা খুব ভাল করে জানেন। কুষ্টিয়া থেকে ষোল কিলোমিটার দূরে শ্রী মাতৃমন্দিরের সভাপতি সাদা মনের মানুষ নামে খ্যাত সন্তোষ কুমার দে আমাকে নামযজ্ঞ শোনার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। কুষ্টিয়া মহাশ্মশান থেকে গোবিন্দ বাবু, নিলয় বাবু, টিংকু চক্রবর্তী ও আমি একত্রে দুই মটরসাইকেলে চেপে মিরপুরের মন্দিরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। গ্রামীণ পরিবেশে ছোট্ট মেলা, মন্দিরের সামনেই প্যান্ডেল করে চলছে নামযজ্ঞ অনুষ্ঠান। আমি ঢাকার বাণিজ্য মেলা থেকে শুরু করে বৈশাখ মেলা একুশের মেলা, পৌরষ মেলা অনেক মেলাই দেখেছি কিন্তু গ্রামীণ পরিবেশে হাল্কা আঙ্গিকে আয়োজন করা মেলাটি আমার কাছে অপূর্ব লেগেছিল। স্বল্প পুঁজির বিক্রেতা বা দোকানীদের ঘরে কম দামের পশরা এবং গরীব ক্রেতাদের কেনা-বেচা আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় লাগছিল। সাথে ক্যামেরা নেওয়াতে বাড়তি সুবিধা হয়েছিল। বেশকিছু দলের আসর ও মেলার ছবি তুলে নিয়ে এসেছিলাম। আমরা কুষ্টিয়া মহাশ্মশান থেকে এসেছি এ কথাটি চারিদিকে খবর হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে মাতৃমন্দিরের মাইকে আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য কমিটির স্বেচ্ছাসেবকদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছিল। আমাদের জন্য আলাদাভাবে চেয়ারের ব্যবস্থা করে প্যান্ডেলের বিশেষ একটি কর্ণারে বসার জায়গা করে দেওয়া হল। তখন দুপুর বেলা আমি মনোযোগ দিয়ে গান শুনছিলাম, আসরে শ্রীদূর্গা সম্প্রদায়ের পরিবেশনায় রাগ মনোহরশই চলছিল। এরপর কাজলী রাগ নিয়ে নামলো ভক্ত হরিদাস সম্প্রদায়। দলের মালিক পঙ্কোজ বণিকের বাজানো খোল যেন কথা বলছিল। আমার দেখা এত অদ্ভুত ও অসম্ভব মেধা সম্পন্ন খোল বাদক কখনো সামনে পড়েনি। পরে জানতে পারলাম এই ব্যক্তিই সারা বাংলাদেশে কীর্ত্তনীয়াদের মধ্যে প্রবীণতম সেরা খোল বাদক। ভক্ত হরিদাস দলের মাষ্টার বিষ্ণু সরকার তার হারমনিয়াম ফিংগারিং ও সুর ললিত কারুকাজ আমার কাছে চমৎকার লেগেছিল। আর এই দলের বংশীবাদক সিলেটের তীর্থ চক্রবর্তী উচ্চাঙ্গ সংগীতের দীকপাল বললে ভুল হবে না। পরবর্তী যে ছয়দিন কুষ্টিয়া মহাশ্মশানে আসর করেছেন তিনি প্রতিদিনই আমাদের সাথে আমার বাসায় বসে ক্ল্যাসিকাল গানের ঘরোয়া জলসায় যথেষ্ট সময় দিয়েছেন। এদিকে গোবিন্দ বাবু ও নিলয় বাবু অন্য দলগুলোর সাথে প্রয়োজনীয় কথা সম্পন্ন করে ফেললেন। ফেরার সময় হলে গেল দুপুরের সেবা নিয়ে আমরা কুষ্টিয়া উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কুষ্টিয়া মহাশ্মশানে রাত ১২ টায় অধিবাস শেষ করে পরদিন ভোর থেকে ছয়দিনের নামযজ্ঞানুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। ভোর ৬টা থেকে সকাল ১০ পর্যন্ত নিরিবিলি পরিবেশে কীর্ত্তনীয়া দলের সুর যে কোন মানুষের অনুভূতিকে আলাদাভাবে আন্দোলিত করে থাকে। সেকারনে আমার সাথে কয়েকজন শ্রোতা শংকর বাগচী, ড. অরবিন্দ সাহা, মনোজ মজুমদার ও নারায়ণ সাহা মিলপাড়ার মধ্য দিয়ে মহাশ্মশানের উদ্দেশ্যে হেটে চলছিলাম। এমন সময় একটি বাসার জানালা দিয়ে হারমনিয়ামের সাথে একজনের দরাজ কন্ঠে ভৈরবী সুর ভেসে আসছিল। আমরা সবাই জানালার কাছে থমকে দাঁড়িয়ে গৃহের মধ্যে গুরু বাক্য শুনছিলাম। তিনি শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বলছেন অষ্ট প্রহরের ৩৬ রাগিনী দিয়ে নিজের চোখের অশ্র“ না ঝরিয়ে সুরের সুধা দিয়ে ভক্তের চোখে জল আনাটাই একজন গুনী শিল্পীর কুশলতার পরিচয় মেলে আমার কৌতহল বেড়ে গেল, বোধহয় সংগীত জগতের যে সোনার খনীর সন্ধান করছিলাম তা আজ মিলে যেতে বসেছে। হারমনিয়ামের বিভিন্ন সুর আশেপাশের পরিবেশকে সুমধুর করে তুলছিল আমি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। অন্যেরা শ্মশানে চলে গেলেন, আমি আর শংকর বাগচী গুরু গৃহের প্রবেশ দ্বারে হাত জোড় করে অনুমতির অপেক্ষা করছিলাম। শিষ্যরা জায়গা করে দিল ঠিকই আমরা দুজনে দাঁড়িয়েই রইলাম। গুরু আমাদের দিকে দৃষ্টি পড়তেই ইশারায় বসতে বললেন। এরই মধ্যে আধাঘন্টা কাল আমাদের সাথে কোন কথা না বলে শিষ্যদের যা বোঝাচ্ছিলেন সেগুলো বিমুগ্ধ শ্রোতার মত আমরা সুর সাগরে অবগাহন করছিলাম। একজন শিষ্য পাশে বসে হারমনিয়াম বাজাচ্ছে তার কুশলতা গুরুকে সুর সৃষ্টি করতে সহায়তা করছে। সূর্যদ্বয়ের আগেই ললিত শেষ করে কোন কোন পর্দার সহযোগে ভোরের রাগ ভায়রো বা ভৈরবীতে প্রবেশ করতে হয় তা শেখাচ্ছিলেন। প্রতিটি কীর্ত্তনের আসর দুইঘন্টা করে অনুষ্ঠিত হয়। খেয়াল গানের শুরুতে যেমন আলাপ করা হয় তেমনি কীর্ত্তন প্রথম আধাঘন্টা সময় ধরে যে রাগ গাওয়া হবে তার আরোহন অবহরন ও পকড়, চলন দিয়ে বন্দনার মাধ্যমে ভাবের আবেশ সৃষ্টি করা হয়। নাম কে সুমধুর করে ভক্তদের মাদকতা আনতে হলে কোন কৌশলে মিশ্র পর্দা ব্যবহার করা যায় সেগুলি নিজে গেয়ে চমৎকার ভাবে দেখালেন। দরবারী কানাড়া ও শিবরঞ্জন গেয়ে গভীর রাত অণুভব করালেন। পরে মিয়াকিমল্লার গেয়ে বর্ষণমুখর রাত্রি অনুভব করিয়ে ঈশ্বর বন্দনা করলেন। সুর সাধনের এক ফাকে আমাদের উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞসা করলেন দাদাদের পরিচয়? শংকর দা বিশেষভাবে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। উনি একটু থমকে বললেন আপনি কি সেই ব্যক্তি গত বছর কীর্ত্তন শিল্পীদের নিয়ে সম্বর্ধনা ও সংগীত আসর করেছিলেন। হাত বাড়িয়ে আমাকে একবারে কাছে নিয়ে বসালেন। বললেন, অনেকের মুখে আপনার কথা শুনেছি, আপনার বাসায় নাকি এই উপমহাদেশের নাম করা শিল্পীদের সেতার, বাঁশি, সানাই ও ক্ল্যাসিকাল গানের সংগ্রহ আছে? আমি বিনয়ের সাথে জানালাম একজন সংগীত শ্রোতা হতে গেলে যতটুকু সংগ্রহ করা প্রয়োজন তাই করে যাচ্ছি আর কি। উনি নিজেই আমার ক্ল্যাসিকাল সংগ্রহ দেখার আগ্রহ দেখিয়ে বাসায় যাবার নিমন্ত্রণ নিলেন। আমি কড়জোরে তার পদধুলির দিনক্ষণ প্রার্থনা করলাম। বললেন পাঁচ দিন কুষ্টিয়াতে আছি এরই মধ্যে সময় করে নেব। আজ রাত্রি ৮-১০ কীর্ত্তনের আসর আছে শুনতে আসবেন তো? আমি বললাম কোন রাগ গাইবেন? উনি আমার উপর ছেড়ে দিলেন কোনটা শুনতে চান এই প্রহরে সম্ভবত আপনারা জয়জয়ন্তী, খামবাজ, বাঘেশ্রী, সিন্ধু ইত্যাদি রাগ গেয়ে থাকেন। তিনি কবি নজরুলের মত বুক ভাটা হা হা করে হাসি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন অভোলন অভোলন এমন শ্রোতাই তো চাই। আপনারা লালনের দেশের মানুষ সংগীত খুব ভাল বোঝেন আমরা কুষ্টিয়া মহাশ্মশানে খুব সর্তকতার সাথে গান গেয়ে থাকি। আপনাদের মত পাঁচজন শ্রোতা আসরের সামনে থাকলে আমরা প্রাণঢেলে নামের সাথে সুর সুধা দিয়ে কীর্তিবোধ করি। বিদায়ের সময় গুরুর পরিচয় জানতে পারলাম তিনি ভক্ত নরোত্তম সম্প্রদায়ের মালিক ও সারা বাংলাদেশের সংকীর্ত্তনীয়া দলের সমিতির সাধারণ সম্পাদক উত্তম চক্রবর্তী। আর পাশে বসে হরামনিয়াম সংগত করছিল তারই যোগ্য সন্তান তুষার চক্রবর্তী। বিদায় নিয়ে শ্মশানে উপস্থিত হয়ে দেখি মাত্র দশ/বার জন শ্রোতা নিয়ে মুক্তিলতা সম্প্রদায় আনন্দ ভৈরবী পরিবেশন করছিলেন মাষ্টারের কাছে গিয়ে বললাম আশাবরী/বিভাস রাগ শোনানো যাবে কিনা। মাথা ঝুকিয়ে সম্মতি জানালেন। আমরা এই চারজন মূলত সুর শুনতে এসেছি। যে রাগ গাইবেন তার চরিত্র যেন পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পায়। মাষ্টার একটু ভেবে নিয়ে দলের প্রকৃত খোল বাদককে ইশারা করে আসন ঘুরিয়ে আমাদের মুখোমুখি হয়ে বসলেন। এবারে একটানা ত্রিশ মিনিট ত্রিতালের সাথে আশাবরী রাগ গেয়ে বিভাসের মধ্যে ঢুকে পড়লেন আমরা সবাই মোহিত হয়ে তার সংগীত শুনছিলাম। এই দলের বাঁশি বেহালা বাদকের যুগলবন্দি দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম কীর্ত্তন দলের শিল্পীরা যে যুগলবন্দি পরিবেশন করতে পারে তা আমার জানা ছিল না। গত বৎসর ঢাকাতে শাহবাগের ঢাকা ক্লাবের মাঠে ওস্তাদ আমজাদ আলী খাঁর সরোদ বাদনের সাথে তবলার যুগলবন্দি সরাসরি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, যার টিকিটের মুল্য ছিল পঁচিশশত টাকা। আজ বিনা পয়শায় কুষ্টিয়া মহাশ্মশানে বসে বাঁশি, বেহালা ও খোলের যুগলবন্দি শুনতে পাচ্ছি একি কম পাওয়া। আসর শেষে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় বংশীবাদক সিলেটে বাড়ী তীর্থ চক্রবর্তী আমাকে নমস্কার করে বললেন আমি আপনাকে চিনি আপনি জাহিদ স্যার। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। সে বলল অনেকের কাছে গল্প শুনেছি আপনার কাছে উপমহাদেশের বিখ্যাত শিল্পীদের বাঁশির সিডি সংগ্রহ আছে, আর সংগীত শোনার উপযোগী একটি কক্ষ আছে। আমার খুব ইচ্ছে আপনি যদি ওইগুলি দেখার সুযোগ করে দেন। আমি সহাস্যে তীর্থ এবং তার দলের মাষ্টার বিষ্ণু সরকার ও তুষার চক্রবর্তীকে সংগে নিয়ে আমার বাসায় প্রবেশ করলাম। আমার সংগীত ঘরে ঢুকেই তারা একের পর এক সিডি দেখছে আর কপালের সাথে ঠেকিয়ে প্রণাম জানাচ্ছে তাদের একটি আচরণ আমাকে ইর্শিত করেছিল উস্তাদ বিসমিসল্লাহ খাঁর প্রতি প্রবল ভক্তি ও শ্রদ্ধা। এই এক সপ্তাহে প্রায় ডজন খানিক কীর্ত্তন শিল্পী আমার বাসায় গান শুনতে এসেছে। প্রত্যেকেরই প্রথম ইচ্ছা বিসমিল্লা খাঁর সানাই আগে দেখাতে হবে আমার কাছে বেনারস উৎসবের একটি লাইভ প্রোগ্রামের সিডি সংগ্রহে ছিল। ঐ প্রোগ্রাম দেখার সময় তাদের চোখে মুখে দারুন ভক্তি ও শ্রদ্ধার বহিপ্রকাশ লক্ষ্য করেছি। এরপরে একে একে তারা দেখা শুরু করল ভীমসেন যোশি, পন্ডিত যশোরাজ, বড়ে গোলাম আলী, আমীর খান, রশীদ খান, পারভীন সুলতানা, অজয় চক্রবর্তীসহ অনেক গুনি গায়কের খেয়াল গান। এক পর্যায়ে বিভিন্ন শিল্পীর যন্ত্র সংগীত শুনতে চাইলে পান্না লাল ঘোষ ও হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশি, রবিশংকর নিখিল ব্যানার্জীর সেতার, আলী আকবর খাঁ ও আমজাদ আলী খাঁর সরোদ, সন্তুর, সারেঙ্গী, বেহালা ও তবলার লহরা তারা এক সপ্তাহ ধরে উপভোগ করেছিল। আমার বাড়ির গান শোনার ঘর খানি যেন কীর্ত্তন শিল্পীদের কাছে একটি আকর্ষণের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

সন্ধ্যায় উত্তম চক্রবর্তীর আসর দেখার জন্য আমরা সপরিবারে শ্মশানে উপস্থিত হলাম তখনও আসরে গৌরাঙ্গ সম্প্রদায়ের মালিক শ্রীবাস রায় তার বাজানো বেহালায় ইমন রাগের সুর বাজাচ্ছেন। মাষ্টার বাবলু বিশ্বাস, সুমন চক্রবর্তী তাদের সুরের লাতিত্ব প্রদর্শন করে শ্রোতাদের মাতিয়ে তুলেছেন। অতপর উত্তম চক্রবর্তী তার এগার জনের একটি দল নিয়ে খাম্বাজ রাগের সুর আলাপরত অবস্থায় রবীন্দ্রনাথের মত দৃপ্ত পায়ে মঞ্চে প্রবেশ করল। আমরা বেশ কজন সঙ্গীত বোদ্ধা ও শিল্পী একত্রে চেয়ারে বসে আছি। উত্তম বাবু আমাদের দিয়ে দৃষ্টি পড়তেই সকলের উদ্দেশ্যে হাত জোড় করে প্রণাম জানালেন। আমরাও যথারীতি তার প্রতি শ্রদ্ধা বিনিময় করলাম। মঞ্চের একপাশে সকল গায়ক বাদক বসে খাম্বাজ রাগের বন্দনা গাইতে শুরু করলেন। গুরু উত্তম চক্রবর্তী আজ একটু বেশী করে আলাপ ও কন্ঠের চলনশৈলী প্রদর্শন করছেন। সেকারণে দলের সকল সদস্য শিল্পী নিমগ্নচিত্তে গুরুর প্রতি দৃষ্টি মিলে আছে, কখন কার প্রতি কি প্রতিকী নিদের্শনা আসে। বিলম্বিত শুরু করে কখন মধ্যলয় ও জলদে যেতে হবে তার হাতের ইশারায় দুইজন খোল বাদক প্রাণন্ত বাজিয়ে চলেছেন। বেহালা, দোতারা ও হারমনিয়ামে কখন তীব্র পিচ দিতে হবে তাও হাতের অঙ্গুলী নির্দেশনায় পুরা দল পরিচালিত হচ্ছে। এমনিভাবে কিভাবে পয়ত্রিশ মিনিট কেটে গেল আমরা বুঝে উঠতে পারলাম না। তাঁর সুর মূর্ছনার মায়া জ্বালে আমাদেরকে সম্মোহিত করে রেখেছিল। এবার সমস্ত দল উঠে দাঁড়িয়ে খাম্বাজ থেকে সিন্ধু রাগে প্রবেশ করতে করতে মঞ্চে চর্তুরদিকে ঘুলে এল। আসরের সবশেষে মালকৌষ রাগের চলশৈলী দেখিয়ে সমস্ত ভক্ত শ্রোতাদের বিমোহিত করেছিলেন। মালকৌষ রাগের জ্ঞ,দ,ণ কোমল স্বর তিনি চমৎকার ভাবে পুত্র তুষারকে হারমনিয়ামে অঙ্গুলী প্রদর্শন করে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন তাও একটি দেখার মত বিষয়। হরে, কৃষ্ণ, রাম এই তিনটি শব্দ ষোলবার উচ্চারিত হবে যে কোন প্রহরের রাগরাগিনী মিশ্রিত সুরের মধ্যে থেকে এটি নামযজ্ঞের প্রধান বিষয়। শব্দগুলির ব্যবহারে সুরের কারুকার্য্য প্রদর্শন করে সামনে বসে থাকা ভক্ত শ্রোতাদের কান্নায় বুক ভাসানোর দৃশ্য না দেখলে বলে বুঝানো মুশকিল। এমনিভাবে দুইঘন্টার আসর শেষে করে উত্তম চক্রবর্তী মঞ্চ থেকে নেমে সরাসরি আমাদের সাথে এসে বুক মেলালেন। প্রায় পাঁচ ছয়শত দর্শকের আমাদেরকে এ ধরনের সম্মান দেওয়াতে আমরাও গর্ব অনুভব করলাম। শ্মশান কমিটির অনেকেই এগিয়ে এলো কোন কোন ভক্ত তার গলায় গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে গড় হয়ে প্রণাম করতে লাগল।
শ্মশানের অদূরেই রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত “টেগর লজ” কুষ্টিয়ার কুঠিবাড়ী নামে খ্যাত, আমি এবং উদীচির সম্পাদক সমর রায় সেখানে ছবি আঁকা ও সংগীত প্রশিক্ষণের ক্লাস পরিচালনা করে থাকি। পরদিন সন্ধ্যায় “টেগর লজে” মহাশ্মশানে আগত কীর্ত্তন দলের শিল্পীগণ ও কুষ্টিয়া সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে এক মিলন মেলার আয়োজন করলাম। সেখানে উত্তম চক্রবর্তীকে তার দলবল নিয়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালাম। পরদিন সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে পৌর মেয়র আনোয়ার আলী সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখলেন ডাঃ সুকুমার কুন্ডু, ড. অরবিন্দ সাহা, এ্যাডভোকেট সুব্রত চক্রবর্তী, হাফিজুর রহমান, অসিত বাবু, বরুন বাবু, শিশুশিল্পীরা ফুল কীর্ত্তন শিল্পীদের বরণ করে নিল। আমি নিজেই অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলাম। জলাসার শুরুতে শ্রীবাস রায় বেহালায় গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা এই গানের সুরে আগত দর্শক শ্রোতাদের অভ্যর্থনা জানালেন। এরপর স্থানীয় শিল্পী অখিল দেবনাথ ও সুব্রত চক্রবর্তী নজরুলের দুইটি বিখ্যাত শ্যামা সংগীত, শ্মশানে জাাগিছে শ্যামা মা ও শ্যামা নামের লাগলো আগুন পরিবেশন করলেন এরপর নিহার মন্ডল অনুপ জালোটার দুইটি ভজন গাইলেন। সুমন চক্রবর্তী পরিবেশন করলেন ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে এই গানখানি। মধ্যমনি উত্তম চক্রবর্তী ও সঞ্জয় কুমার গাইন একটু শলা পরামর্শ করে নিয়ে প্রথমে উত্তম বাবু গোলাম আলীর দুইখানা বিখ্যাত গজল ইয়ে দিল ইয়ে পাগল দিল মেরা ও হামকো কিসনে গামনে মারা ইয়েকাহানি ফির সাহে পরিবেশন করলেন। পর সঞ্জয় কুমার গাইন অজয় চক্রবর্তী বিখ্যাত গান ডাগর নয়নে কেন চেয়ে থাক এবং বিভাস রাগে মোহন বাঁশি বাজে দুইটি গান পরিবেশ করেন দর্শকদের বিশেষ অনুরোধে প্রায় পঁচিশ মিনিট ধরে আলাপসহ বর্ষার রাগ, কেদার পরিবেশন করেন তখন চারিদিকে মূষলধারে বৃষ্টি ঝরছে, কখন ঘড়ির কাটা রাত ১১ গিয়ে ঠেকেছে কারোও খেয়াল নেই শ্রোতাদের মধ্যে যেন একটা অতৃপ্ত সুর বাসনা কাজ করছিল। কীর্ত্তনীয়া স্থানীয় শিল্পীদের কন্ঠে লালনের গান শুনতে চাইলেন। শ্রোতাদের মাঝে লালন গানের শিল্পী আব্দুল কুদ্দুস ও আসলাম শাহ দুইখানি লালন সংগীত পরিবেশন করলেন। তাদের সাথে তবলা সংগত করলেন প্রদীব অধিকারী, সংকর চৌধুরী ও দিপু সবশেষ পরিবেশনা কুষ্টিয়ার দুইজন সনামধন্য উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী মজেজ বিশ্বাস ও সালাউদ্দিন আহমেদ পরিবেশন করলেন মেঘ রাগ ও মিয়াকি মল্লার রাগ। খেয়ালের তান তারনা ও সুরের মূর্ছনার সাথে বাইরের অঝোর ধারার বর্ষণ যেন প্রকৃতির এক অনবদ্য খেয়ালী খেলা শুরু হয়েছিল। একজীবনে এমন পরিবেশে বর্ষার রাগ উপভোগ করার সুযোগ সবার জীবনে ঘটেনা এই আয়োজনটা মনে হয়েছিল জীবনের একটি সফল ও সার্থক অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে একটি।
কীর্ত্তন শিল্পীদের মধ্যে অনেক গুনী গায়ক ও বাদক আছেন তারা শুধুমাত্র জীবিকার প্রয়োজনে বায়নার মাধ্যমে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গান গেয়ে বেড়ান। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এদের মধ্য থেকে অনেক খ্যাতিমান শিল্পী ও বাদক বের করে আনা সম্ভব। শিল্পকলা একাডেমীতে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে কীর্ত্তন শিল্পীদেরকেও এ ধরনের প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করে দিলে এদের মধ্য থেকে অনেক গুনি শিল্পী বেরিয়ে আসতে পারে। তারা দেশের সংস্কৃতি ভান্ডারকে আরো সমৃদ্ধি করে দেশে ও বিদেশে সুনাম বয়ে আনতে সক্ষম হবে বলে বোদ্ধা সঙ্গীতজ্ঞরা মনে করেন।
[লেখক মীর জাহিদ : শিক্ষক, স্থপতি ও চিত্রশিল্পী]

কোন মন্তব্য নেই: