শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০০৯

৩২ নম্বরের বাড়িতে যা ঘটেছিল

নজরুল ইসলাম খান
চাকরির সুবাদে একজন মহান নেতাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন অত্যন্ত সরলমনা, আবেগপ্রবণ। সরল মনে সহজেই অন্যের কথা বিশ্বাস করতেন। তার সরল বিশ্বাসের সুযোগেই খুনিরা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যা করতে পেরেছিল।
১৯৭৫ সালের ১৪ আগষ্ট রাত ৮টা থেকে ১৫ আগষ্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির হাউস গার্ডের দায়িত্বে কর্তব্যরত ছিলাম। আমার সাথে ঢাকা জেলা পুলিশের ইন্সপেক্টর খোরশেদ আলী হাউস গার্ডেরই তদারকির দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া পুলিশের আর্মড সাব ইন্সপেক্টর, একজন হেড কনস্টেবল সেন্ট্রি বদলের দায়িত্বে থাকতেন। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের চারদিকে ৮টি সেন্ট্রি পোষ্ট ছিল- বাসভবনের দক্ষিণে ৩টি, উত্তরে ২টি, পর্বে ১টি ও পশ্চিমে ১টি। উত্তরের সেন্ট্রি পোস্টের ১টিতে পুলিশ ও ১টিতে আর্মি দিয়ে, দক্ষিণের ২টিতে আর্মি দিয়ে এবং বাকি ৪টি পুলিশ দিয়ে গার্ড দেয়া হতো।
আর্মির সুবেদার মেজর গার্ড বদল ও অন্যান্য দায়িত্ব পালন করতেন। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে লেকের পাড়ে আর্মি। ব্যারাক ছিল। সেখানে হাউস গার্ডের ২০/২৫ জন রিজার্ভ আর্মি ও সুবেদার অবস্থান করতেন। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল দ্বৈত নিয়ন্ত্রণে। পুলিশ ও আর্মির সম্মিলিত ডিউটি থাকতো। রাত ৮টা থেকে প্রতি ৪ ঘন্টা পরপর সেন্ট্রি বদল করা হতো। প্রতিদিনের মত ঘটনার রাতে সেন্ট্রি বদল করা হয়।
১৫ আগষ্ট ১৯৭৫। ভোর রাত আনুমানিক পৌনে ৫টার সময় আমি ও আমার সাথে একজন পুলিশ সার্জেন্ট (নাম মনে নেই) বঙ্গবন্ধুর ড্রইংরুমে বসে বিশ্রাম করছিলাম। এমন সময় বঙ্গবন্ধুর গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। মনে হলো তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে জোড় গলায় কারো সাথে কথা বলছিলেন। শুনতে পেলাম তিনি বলেছিলেন কেন দুস্কিৃতকারী আসবে, আপনারা কি করেন। আপনারা থাকতে কেমন করে দুস্কৃতিকারী আসতে পারে। কেমন করে আমার বাসায় দুস্কৃতিকারী আসে। আপনারা কি করছেন। এই সব কথা বলার ১০/১২ সেকেন্ড পর টেলিফোন রেখে দেবার শব্দ শোনা গেল। আমি ও আমার কাছে বসে থাকা পুলিশ সার্জেন্ট এ সব কথা শুনে ভাবলাম বঙ্গবন্ধু নিচে আসতে পারেন। তাই আমরা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম এবং ড্রইংরুমের দরজার কাছে যেতেই বাইরে থেকে ফায়ারিং শুরু হয়ে গেল। তখন ভোর আনুমানিক ৪-৫০ মিনিট। আমি সেন্ট্রিদের জিজ্ঞাসা করলাম, কোথা হতে ফায়ারিং হচ্ছে। সেন্ট্রি বলল বাইরে থেকে ফায়ারিং হচ্ছে। আমাদের উপর হামলা হচ্ছে। আমি বললাম তোমরাও ফায়ার চালাও। তখন উভয় পক্ষে গুলিবিনিময় হতে লাগল। এর মধ্যে ৪/৫টি কামানের গোলা বা গ্রেন্ডের শব্দে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কেঁপে উঠল। আনুমানিক ৫ মিনিট গোলাগুলির পর উভয়পক্ষের গোলাগুলি বন্ধ হলো। এমন সময় বঙ্গবন্ধু বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। আমি ও পুলিশ সার্জেন তার পাশে এসে দাঁড়ালাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এত গুলি কিসের। আমি বললাম, বাইরে থেকে হামলা হয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আর্মি এসে গেছে নাকি। আমি বললাম, স্যার ঠিক বুঝতে পারছি না। দেখি- এই বলে আমি বাসভবনের সামনে রাস্তার পূর্বে ও পশ্চিমে সবদিক লক্ষ্য করে দেখতে পাই খাকি ও কালো পোশাকধারী লোকজন ত্র“লিং করতে করতে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাসভবনের দিকে এগিয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধুও তা বারান্দায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলেন ও বললেন, আর্মি এসে গেছে আমাদের সাহায্য করতে। তিনি আদেশ করলেন ফায়ারিং বন্ধ কর, ফায়ারিং বন্ধ কর। সেমসাইড হয়ে যেতে পারে। একথা বলে বঙ্গবন্ধু উপরে চলে গেলেন। ফায়ারিং তখন বন্ধ হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু দোতলায় উঠে যাওয়ার পরপরই শেখ কামাল ১টি এসএলআর হাতে নিয়ে গাড়ি বারান্দার সামনে আসেন। আমি ও পুলিশ সার্জেন্ট তার কাছে গেলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আর্মি এসে গেছে নাকি। আমি বললাম আর্মি এসে গেছে বলেই তো মনে হচ্ছে। খাকি ও কালো পোশাক পরা লোকদের বাড়ির বাইরে ক্রলিং করতে দেখা গেছে। শেখ কামাল দাঁড়িয়ে আর্মির মুভমেন্ট দেখলেন এবং মনে মনে আশ্বস্ত হলেন। তিনি উৎফুল্ল হয়ে গাড়ি বারান্দার নিচে নেমে এক পা, দু পা করে এগোতে থাকলেন গেটের দিকে। আমি ও পুলিশের সার্জেন্ট তার সঙ্গে গেলাম। শেখ কামাল গেটের বাইরের দিকে লক্ষ্য করে ডাকতে লাগলেন, আর্মি ভাইয়েরা, কারা এসেছেন, ভিতরে আসুন। কোন উত্তর এলো না। চারদিকে নিস্তব্ধতা। হঠাৎ করে ৫/৬ জন খাকি ও কালো পোশাক পরা আর্মি, প্রত্যেকে অস্ত্র হাতে, অনগার্ড পজিশনে গেটে ধাক্কা মেরে বাসভবনে ঢুকে পড়লো। তারা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে বলে, হ্যাণ্ডসআপ। আমি ও পুলিশ সার্জেন্ট খাকি পোশাক পরিহিত ছিলাম বলে হ্যান্ডসআপ করি। শেখ কামাল আশ্চর্য হয়ে বলেন, আমি শেখের ছেলে কামাল। তারা পুনরায় আদেশ দেন, হ্যান্ডসআপ। তখন শেখ কামাল তার হাতের এসএলআরটি নিচে নামিয়ে হ্যান্ডসআপ করতেই আর্মির ঘাতকরা পিছনে মোটা করে একজন, হাতে থাকা এসএমজি দিয়ে ৭/৮হাত দুর থেকে শেখ কামালকে লক্ষ্য করে গুলি করে। শেখ কামাল ওরে বাবারে বলে চিৎকার করে খোড়াতে খোড়াতে বারান্দায় উঠে রিসেপশনিষ্ট রুমে গিয়ে পড়ে যান। আমি আড়চোখে এ দৃশ্য দেখি। এরপর উক্ত ঘাতক ছাড়া ৪/৫ জন ঘাতক উপরে উঠে যায়। শেখ কামালকে গুলি করার পর ওই ঘাতক আমাকে লক্ষ্য করে ২টি গুলি করে। একটি গুলি আমার ডান পায়ের হাটুর উপরে লেগে বিধে যায় এবং অপর গুলিটি আমার ডান পায়ের জুতো ভেদ করে কনিষ্ঠ আঙ্গুলের হাড় ভেঙ্গে চলে যায়। আমার পা দিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর বাসভবন আক্রমণ শুরু করার আগ মুর্হূতে বাড়ির সব টেলিফোন লাইন কেটে দেয়। আমরা বুঝতে পারছিলাম ঘাতকরা বেশ কিছুক্ষণ যাবত চেষ্টা করে বঙ্গবন্ধুর ঘরে দরজা খোলার কিন্তু খুলতে পারছিল না। তাদের কথাবার্তায় বুঝতে পারছিলাম তারা ঘরের দরজার চৌকাঠের নিচ দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে দরজা খোলার চেস্টা করছিল। এ সময় তাকিয়ে দেখি খাকি ও কালো পেশাাকধারী ঘাতকরা অনেকেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে ঢুকে পড়েছে। তারা পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র ও গুলি সিজ করে নিয়ে তাদের গেটের ভেতর লাইনে দাড় করাচ্ছে। আমাকেও একজন ঘাতক অস্ত্রের মুখে দাড় করাল। আমি গেটের বাইরে তাকিয়ে দেখি বাইরে একটি কামান সজ্জিত ট্যাংক। তাতে কালো পোশাক পরা ৫/৬ জন আর্মি। তাদেরকে আর্টিলারী বলে মনে হল। বাইরে রাস্তায় আর্মির একটা সাজোয়া গাড়ি। তখন বাসার ভেতরে গোলাগুলি ও মহিলাদের আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছিল।
বঙ্গবন্ধুর পিএ মোহিতুল ইসলাম মোহিত, স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাব ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমান, পুলিশ ইন্সপেক্টর খোরশেদ আলী, একজন পুলিশ আর্মিড সাব ইন্সপেক্টর, একজন হেড কনস্টেবল, একজন নায়েক, ১৪/১৫ জন পুলিশ কনস্টেবল এবং সাদা পোশাকে বাড়ির কাজে সিভিল চাকরিজীবীদের লাইনে দাড় করানো হল। আমি কোন রকমে একটি সুপারিগাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় পুলিশ আর্মড সাব ইন্সপেক্টর কে জানালেন, মোট ১৫৯ রাউন্ড গুলি করা হয়েছে।
এরপর একজন ঘাতক এসে আমাকে বলে তোমার আদেশে পুলিশগুলি করেছে। আমাদের অনেক লোক ক্ষতি হয়েছে। চল তোমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারব। এই বলে অস্ত্রের মুখে লাইন থেকে আমাকে গেটের বাইরে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে রাস্তাায় দাড় করিয়ে আর্মির সাজোয়া গাড়ির সামনের সিটে বসা খাকি পোশাক পরিহিত অফিসারকে বলে, স্যার এ লোকের হুকুমে গুলি হয়েছে। আমাদের লোকের ক্ষতি হয়েছে। আদেশ দেন তাকে গুলি করে মারি। অফিসার আমার নাম জিজ্ঞাসা করে বলেন, এ বাড়িতে আপনি কেন। আমি বলি, রাতের বেলায় এ বাড়িতে আমার ডিউটি ছিল। আর্মি অফিসার বলেন উনি থাকুক। আমাকে বললেন আপনি যান। আমি গেটের ভেতরে না গিয়ে রাস্তায় পশ্চিম দিকে যেতে উদ্যত হলে উক্তি ঘাতক গেটের ভেতর নিয়ে লাইনে দাড় করিয়ে দিল। তখনো উপরে গোলাগুলির শব্দ চলছিল। এমন সময় একজন ঘাতক হুকুম দিল লাইনে দাঁড়ানো সবাইকে গুলি করে মেলে ফেল। অমনি আমাদের লাইনে একজন ঘাতক ১ রাউন্ড গুলি করলে স্পেশাল ব্রাঞ্চের এসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমানের বুকে লাগে এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে পড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বঙ্গবন্ধুর পিএ মোহিতুল ইসলাম জখম হয়েছিলেন। তার গায়ের জামা কাপড়ে রক্তের দাগ ছিল। আমার কাছে লাইনে দাঁড়ানো পুলিশ ইন্সপেক্টর খোরশেদ আলীকে একজন ঘাতক লাইন থেকে বের করে মাটিতে শুইয়ে গুলি করতে উদ্যত হলে তিনি অনেক কাকুতি মিনতি শুরু করেন। পরে কি ভেবে ঘাতক গুলি করা থেকে বিরত থাকে। এর মধ্যে ঘাতকরা বাসার রান্নাঘরের কাজের বুড়ি ও বাড়ির রাখালকে ধরে এনে লাইনে দাড় করায়। ওপর থেকে একজন অস্ত্রধারী ঘাতক শেখ নাসের সাহেবকে নিচে লাইনে নিয়ে আসে এবং তাকে কি যেন জিজ্ঞাসা করে নিচের অফিসের বাথরুমে নিয়ে যায়। পরে বাথরুমে ১ রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা যায়। উপরে গোলাগুলি এবং আর্তচিৎকার ¯ক্সষ্ট ভাবে শোনা যাচ্ছিল। এমন সময় খাকি পোশাকধারী রাইফেল হাতে ঘাতক উপর থেকে শিশু রাসেলকে নিচে নিয়ে আসে। রাসেল পিএ মোহিতুল ইসলামকে দেখে দৌড়িয়ে এসে তার হাত ধরে বলে ওঠে আমাকে মারবে নাকি। উত্তরে মোহিত বলেন, মারবে না। ঠিক তখনই উক্ত ঘাতক রাসেলের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গেটের সামনে ডান দিকে সেন্ট্রিপোস্টে রাসেলকে রাখে এবং একজন অস্ত্রধারীকে বলে একে পাহারা দিয়ে রাখ। তখন রাসেল কান্নাকাটি করছিল এবং জিজ্ঞাসা করছিল আমাকে মারবেন। রাইফেলধারী ঘাতক বলছিল, মারবো না। রাসেল বলল তাহলে আমাকে আমার বাবা মার কাছে নিয়ে যান। রাইফেলধারী ঘাতক রাসেলকে রেখে উপরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর এসে ঘাতক বলে চলো তোমার মা বাবার কাছে। এই বলে শিশু রাসেলকে উপরে নিয়ে যায়। এমন সময় বাড়ির কাজের ছেলে আবদুলকে নিয়ে এসে লাইনে দাঁড় করায়। তার গায়ের গেঞ্জি লাল। বুঝলাম আবদুলের পেটে গুলি লেগেছে। উপরে তখনো গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অনুমান সকাল ৬টার সময় ঘাতকদল গোলাগুলি শেষ করে ৪/৫ জন ঘাতক নিচে নেমে এলো। তাদের মধ্যে ৩/৪ জন গেটের বাইরে অপেক্ষামান খাকি পোশাক পরিহিত একজন আর্মি অফিসারের সাথে ইংরেজিতে কথা বলছিল। এক পর্যায়ে বলল, অল ফিনিসড। অল কিল্ড। পরে তারা নিচু স্বরে আরো আলাপ করে এবং বাড়ি থেকে পুলিশদের সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
গেটের কাছে থাকা একজন ঘাতক হুকুম করল সকল পুলিশকে একটি ট্যাংকে তুলে পশ্চিম দিকে নিয়ে যাও। পরে একজন ঘাতক আমাকেসহ সকল পুলিশকে সরিয়ে বাসভবনের সামনে দাঁড়ানো ট্যাংকে তুলে পশ্চিম দিকে সরিয়ে নিয়ে গেল। ট্যাংকটি লেকের ধারে পশ্চিম দিকে ওভার ব্রিজের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে সকল পুলিশকে নামিয়ে দিয়ে আর্মির কর্ডনের মধ্যে রেখে ট্যাংকটি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে চলে যায়।
বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে বের হয়ে আসার সময় আমি আরো একটি ট্যাংক প্রধান সড়কের উপর দাঁড়ানো অবস্থায় দেখি। ১৫ আগষ্ট সকাল ৬-১৫ মিনিট থেকে আনুমানিক ৯টা পর্যন্ত আমাদের আর্মিরা ওভার ব্রিজের উত্তর পাড়ে আটকে রাখে। তখন আমার পা দিয়ে অনবরত রক্ত ঝরছিল। পায়ের জুতো রক্তভর্তি হয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ছিল। আনুমানিক সকাল ৯টার সময় বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে ঘাতকদের একজন আমাদের কাছে এলো। তার কথা শুনে মনে হল তিনি আর্মির একজন মেজর। তিনি আমার নাম এবং পোস্টিং কোথায় জিজ্ঞাসা করলেন। আমি তার জবাব দিয়ে বললাম, আমার রক্ত বন্ধের জন্য একজন ডাক্তার দেখানোর অনুমতি দেয়া হোক। কিছুক্ষণ পর আমার রক্তপড়া দেখে ডাক্তারের কাছে যেতে অনুমতি দেন। এই সময় পুলিশের অন্যরা আমাকে বলল স্যার আমাদের ব্যারাকে যাবার অনুমতি দিয়ে দেন। আমি আর্মির অফিসারকে বললে তিনি ওভার ব্রিজের অপর পাড়ে ব্যারাকে গিয়ে বিশ্রাম করার অনুমতি দেন। তখন সকল পুলিশ ব্যরাকে ফিরে গেল। আমাকে একজন হেড কনস্টেবল রিকশায় করে ধানমন্ডি থানায় নিয়ে যায়। সেখানে সকল ঘটনার কথা ওসি সাহেবকে বলি। ওসি সাহেব একজন সেকেন্ড অফিসারকে নির্দেশ দিলে কয়েকজন কনস্টেবলসহ জিপে করে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে এক্সরে করে আঙুল ভেঙে গেছে বলে প্লাস্টার করে দিয়ে ডাক্তার আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলে। কিন্তু ভয়ে আমি বলি, বাসায় থেকে চিকিৎসা করাবো বলে আমার লালবাগের বাসায় চলে আসি। ৭ দিন ঢাকায় থাকার পর আমি ট্রেনযোগে ময়মনসিংহ চলে আসি। প্রায় তিন মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ঢাকা জেলা পুলিশে যোগদান করি।
ঘাতকরা বা অন্য কেউ বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোন করে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছিল। ভোর রাতে বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে যখন কথা বলছিলেন তার জবাব শুনে আমার মনে হয়েছে কেউ টেলিফোনে বলেছিল কিছুসংখ্যক দুস্কৃতিকারী আপনার বাসভবনে রাতে আক্রমণ করতে পারে। ঘাতক আর্মির লোকজন হয়তো বলেছিল আমরা আপনাকে সাহায্য করার জন্য আপনার বাসভবনে আসছি। বঙ্গবন্ধু তাদের কথা সরল মনে বিশ্বাস করেন এবং গাড়ি বারান্দায় এসে খোজ নিয়েছিলেন আর্মি এসেছে কিনা। সেমসাইড হয়ে যাবে বলে বঙ্গবন্ধু ফায়ারিং বন্ধ করতে পুলিশকে নির্দেশ দেন। আর ঘাতকরা সে সুযোগ নিয়ে পুলিশকে নিরস্ত্র করে সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সকলকে হত্যা করে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার

কোন মন্তব্য নেই: