শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০০৯

স্মৃতি বড় মধুর স্মৃতি বড় বেদনার


শেখ হাসিনা

অনেক রাত হবে। দোতলায় মায়ের ঘরে খাটে আমরা সবাই। আম্মা, আব্বা, ভাই, বোন-কেউ শুয়ে, কেউ বসে খুব গল্প করছে। আব্বাও অনেক কথা বলছেন, আমরা শুনছি। সেই আগের মতো ৩২নং বাড়িটায় সবাই আছি। কিন্তু বাড়িটা একদম বিধ্বস্ত। এখানে ওখানে গুলির দাগ। আমার ঘরের পাশে ছোট্ট একটা ঘরে আলনা ও একটা আলমারি রাখা আছে। বড় একটা আয়না রয়েছে। ঐ আয়নায় কারা যেন গুলি করেছে, ফলে অর্ধেক আয়না ভেঙ্গে গেছে। বাড়ির ইটগুলো বুলেটের আঘাতে কেমন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে আছে। একটা ইটের অনেকখানি বেরিয়ে আছে। এদিকে দরজায় একটা শাড়ি ছিড়ে দু’টুকরো পর্দা ঝুলিয়ে দে’য়া হয়েছে। মায়ের কোলের কাছে শুয়ে ছিলাম আমি। উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে আমার ঘরে ঢুকলাম...
হঠাৎ করে ঠেলিফোনের শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগলো যে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। কেন যেন মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। প্রায়ই এমন স্বপ্ন দেখি সেই আগের মতো সবাই এক সঙ্গে ঐ বাড়িতে- মনে হয় যেন একুশটি বছর আমাদের জীবনে আসেনি। মনে হয় মা বাবা ভাইদের স্বপ্নে দেখি ও কাছে পাই বলেই বুঝি বেঁচে আছি। সারাটা দিন নানা রাষ্ট্রীয় কাজে ও বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ সভা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থেকে কাটিয়ে দিই। কিন্তু রাতে যখন ঘুমুতে যাই, তখন যেন চলে যাই অন্য জগতে, সে জগৎ শুধু আমার, একান্ত আমার, একুশ বছর আগের জীবন।
অনেক স্মৃতিভরা ধানমন্ডি ৩২নং সড়কের বাড়ির জীবনে যে চলে যাই। সেই আগের মতো সবাই আছে। একসঙ্গে হাসছি, কথা বলছি, কখনো রাগ করছি, ভাই বোন খুনসুটিপনা করছি। কখনো মিছিল আসছে, কত স্মৃতি। স্মৃতি বড় মধুর আবার স্মৃতি বড় বেদনার আর যন্ত্রণারও। ঘুম ভেঙ্গে বাস্তব জগতে এলেই সে যন্ত্রণা কুরে কুরে খায়। যতদিন বেঁচে থাকব, এ যন্ত্রনার স্মৃতি নিয়েই বাঁচতে হবে। ১৪ আগষ্ট ১৯৯৫-এ এ বাড়িটিকে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ আজ সেই জাদুঘর দেখতে আসে। প্রত্যক্ষ করে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার স্মৃতিবিজড়িত নির্দশনসমূহ। আজ খুব আনন্দ হয়, আমরা জনগণকে তাদের প্রিয় নেতার বাড়িটি দান করতে পেরেছি বলে। জনগণের সম্পত্তি হয়েছে ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি। এটাই আমার বড় তৃপ্তি। আমরা তো চিরদিন থাকব না। কিন্তু এই ঐতিহাসিক বাড়িটি জনগণেরা সম্পদ হিসেবে সব স্মৃতির ভার নিয়ে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকবে। এখানেই আমাদের সান্তনা। আমরা ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর এই বাড়িটিতে আসি। তারপর থেকে কত গুরুত্বপূর্ণ সভা এই বাড়িতে হয়েছে। সেই ’৬১ সাল থেকে ’৯১ সাল পর্যন্ত কত ঘটনা এই বাড়ি ঘিরে। মাঝখানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট থেকে ’৮১ সালের ১১ জুন পর্যন্ত এ বাড়ি বন্ধ ছিল। আব্বা শাহাদাতবরণ করার পর ওরা বাড়িটি সিল করে দেয়, তারপর আর কেউ প্রবেশ করতে পারেনি।
মনে পড়ে, ১৯৬২ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। মণি ভাই এই বাড়ি থেকেই নিদর্শে নিয়ে যেতেন, পরামর্শ নিতেন। ১৯৬২ সালে আব্বা গ্রেফতার হন। তখনকার কথা মনে পড়ে খুব। আমি ও কামাল পিছনের শোবার ঘরে থাকি। মাঝখানে বাথরুম, তার পরই মা’র শোবার ঘর। তখনও বাড়িটি সম্পূর্ণ হয়নি। আমরা যখন এ বাড়িতে এসে উঠি, তখন কেবল দুটো শোবার ঘর। আর মাঝের বসার ঘরটা হয়েছে। তার অর্ধেকটায় খোকা, কাকা, মণি ভাইসহ অনেক আত্মীয়স্বজন থাকত। মাঝখানে পর্দা ছিল বাক্স সুটকেস দিয়ে, এপারে খাবার জায়গা। সামনে পশ্চিম দিকে একটা শোবার ঘর তখনও অসমাপ্ত। এক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি, বাইরের টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে পুলিশ। জানালার পাশে একজন দাঁড়িয়ে, আর একজন অত্যন্ত সতর্কভাবে গুটিগুটি পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু আমি পর্দার পাশে, ঘর অন্ধকার, আমাকে দেখতে পায়নি। তাড়াতাড়ি কামালের খাটের কাছে গেলাম। ওকে ধাক্কা দিয়ে ওঠাতে চেষ্টা করলাম। “একথা বলেই তাড়াতাড়ি বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে মাকে ডাকলাম। আম্মা ও আব্বা তখন টের পেয়ে গেছেন। মা বললেন, “তোমার আব্বাকে ওরা অ্যারেষ্ট করবে।” ঐ বাড়ি থেকেই আব্বাকে বন্দি করে নিয়ে গেল ওরা। প্রায় পাঁচ ছয় মাস আব্বা জেলে থাকলেন।
১৯৬৪ সালের অক্টোবরে রাসেলের জন্ম। তখনও বাড়ির দোতলা হয়নি। নিচতলাটা শেষ হয়েছে। উত্তর পূর্ব কোণে আমার ঘরেই রাসেলের জন্ম হয়, মনে আছে। আমাদের সে কি উত্তেজনা। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা, খোকা অপেক্ষা করে আছি। বড় ফুফু তখন আমাদের বাসায়। আব্বা ব্যস্ত নির্বাচনী প্রচার কাজে। আইয়ুবের বিরুদ্ধে ফাতেমা জিন্নাহ্কে প্রার্থী করা হয়েছে সর্বদলীয়ভাবে। বাসায় আমাদের একা ফেলে মা হাসপাতালে যেতে রাজি নন। তা ছাড়া এখনকার মতো এত ক্লিনিকের ব্যবস্থা তখন ছিল না। এ সব ক্ষেত্রে ঘরে থাকারই রেওয়াজ ছিল। ডাক্তার নার্স সব এসেছে। রেহানা ঘুমিয়ে পড়েছে, ছোট মানুষটা আর কত জাগবে? জামালের চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু, তবু কষ্ট করে জেগে আছে নতুন মানুষের আগমনবার্তা শোনার অপেক্ষায়। এদিকে তর্ক ভাই না বোন? ভাইদের চিন্তা, আর একটা ভাই হলে তাদের খেলার সাথী বাড়বে। বোন হলে আমাদের লাভ আমার কথা শুনবে, সুন্দর সুন্দর ফ্রক পরানো যাবে, চুল বাঁধা যাবে, সাজিয়ে ফটো তোলা যাবে অনেক রকম করে। অনেক কল্পনা, অনেক তর্ক, সেই সঙ্গে গভীর উদ্বেগ নিয়ে আমরা প্রতিটি মুহুর্ত গুনছি। এর মধ্যে মেজো ফুফু এসে খবর দিলেন ভাই হয়েছে। সব তর্ক ভুলে গিয়ে আমরা খুশিতে লাফাতে শুরু করলাম। ক্যামরা নিয়ে ছুটলাম। বড় ফুফু রাসেলকে আমার কোলে তুলে দিলেন। সে কি তুলতুলে শরীর। আমি চুমু খেতে গেলাম, ফুফু বকা দিলেন। মাথা ভরতি ঘন কালো চুল, ঘাড় পর্যন্ত একদম ভেজা। আমি ওড়না দিয়ে ওর চুল মুছতে শুরু করলাম। কামাল জামাল সবাই ওকে ঘিরে দারুণ হৈচৈ।
দোতলায় ওঠার সিড়িগুলো তখনও প্লাষ্টার হয়নি। মা খুব ধীরে টাকা জমিয়ে এবং হাউস বিল্ডিংয়ের লোনের টাকা দিয়ে বাড়িটি তৈরি করেন। কাজেই অত্যন্ত কষ্ট করেই মাকে এই বাড়িটা করতে হয়েছে। আব্বা মাঝে মাঝেই জেলে যেতেন বলে সব কাজ বন্ধ হয়ে যেত, যে কারণে এ বাড়ি শেষ করতে বহুদিন লেগেছিল। আন্দোলনের সময় বা আব্বা বন্দি থাকা অবস্থায় পার্টির কাজ কর্মে বা আন্দোলনের খরচের টাকাও মা যোগাতেন। অনেক সময় বাজার হাট বন্ধ করে অথবা নিজের গায়ের গয়না বিক্রি করেও মাকে দেখেছি সংগঠনের কাজের জন্য অর্থের যোগান দিতে। কাজেই ধীর গতিতেই বাড়ির কাজ চলছিল। দোতলায় সিড়িতেই বসতাম, গল্প করতাম। কি যে আনন্দ ছিল। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ওখানে গিয়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করতাম। স্কুল ছুটি হলেই বরিশাল থেকে আরজু আসত। ছোট ফুপার বদলির চাকরি। আব্বার ভগ্নিপতি বলে আইয়ুব মোনায়েম সব সময় তার প্রতি যেমন কড়া নজর রাখত আর ঘন ঘন বদলি করত। কোথাও সাত মাস, কোথাও নয় মাস যখন যেমন ইচ্ছা। হবিগঞ্জ থেকে রামগড়, রামগড় থেক ঠাকুরগাঁও, আবারও হবিগঞ্জ এমনি বদলি চলতই। ঢাকা হয়েই যাবার পথ ছিল। রাস্তাঘাট তখন এত ছিল না। প্রায় ওরা ঢাকায় আসত। তা ছাড়া ছুটিতে তো কথাই নেই স্কুল ছুটির সময় মেজো ফুফু, খালা সবাই আসতেন। মাটিতে ঢালাও বিছানা। বারান্দায় চুলা পেতে রান্না। আর সব মিলে লুকোচুরি খেলা। দিনরাত খেলার আর শেষ নেই। যেহেতু বাড়ির কাজ শেষ হয়নি, কাজ চলছে, কাজেই লুকোবার জায়গাও অনেক ছিল। বাসায় যখন বেশি ভিড় হত অথবা মিটিং থাকত, আমি ও শেলী ছাদের উপর বসে পড়তাম। অনেক সময় পানির ট্যাংকির উপর বসে পা ঝুলিয়ে গলা চেড়ে জোরে জোরে পড়তাম। বড় হয়ে অনার্স ক্লাসের পড়াও এভাবে পড়েছি।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বাধল, যুদ্ধের আগে ১৯৬৪ সালে ঢাকায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হল। দাঙ্গায় বহু মানুষকে এ বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হয়। দেশে শান্তি স্থাপনের এবং দাঙ্গা থামাবার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে পরিশ্রম করে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনলেন। এটা ছিল সরকারের একটা চাল। সরকার বিরোধী আন্দোলন থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে নেবার এক কৌশল। কত ঘটনা যে মনে পড়ে। এই বাড়ি যখন তৈরি হয়, ইট ভেজানোর জন্য পানির হাউজ তৈরি করা হয়েছিল। চাচি হেলাল ও মিনাকে নিয়ে ঢাকায় এলেন। রেহানা, জামাল, হেলাল, মিনা সারাদিন বারান্দায় খেলা করত। একদিন আমি বারান্দায় রাখা মোড়ায় বসে বই পড়ছি আর হেলাল বারান্দায় রাখা কাঠের দরজা জানালায় পাল্লার স্তুপের উপর বসে খেলছে। একবার নামছে, একবার উঠছে। এর মধ্যে হঠাৎ হাততালি দিয়ে উঠল মিনা সাঁতার কাটে, মিনা সাঁতার কাটে বলে। জামাল দেখল, মিনা হাউসে পড়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে হাউসে নেমে মিনাকে টেনে তুলল। আমি ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে ভিতরে এলাম। বেশি পানি খায়নি। তবে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
বড় একটা দুর্ঘটনার হাত থেকে বেড়ে গেল। মিনা আমাদের সবার আদরের। আব্বা ওকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। তিনি এই খবর শুনলে আমাদের উপর দিয়ে যে কি ঝড় যাবে, ভাবতেও ভয় পাচ্ছিলাম। ১৯৬৬ সালের কথা। কয়েকদিন ধরে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির সভা চলছিল। আমার তখন উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের কয়েকটা পরীক্ষা, যার নম্বর দ্বিতীয় বর্ষে যোগ হবে। কিন্তু পড়ব কি, মিটিং চলছে বাড়িতে, মন পড়ে থাকে সেখানেই। একবার পড়তে বসি, আবার ছুটে এসে জানালার পাশে বসে মিটিং শুনি, সবাইকে চা বানিয়ে দিই। যাক সে সব। বিকেলে নারায়ণগঞ্জে বিশাল জনসভা হল ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য। আব্বা বিছানায় শুতে গেলেন। আমি পড়তে বসলাম। ঐ বছরই বাড়ির দোতলার কাজ স¤ক্সন্ন হয়েছে। কাজেই দোতলার পিছনের উত্তর পূর্ব দিকের ঘরটা আমার দক্ষিণের বড় জানালা। আমি খুব জোরে পড়তাম ঘুম তাড়ানার জন্য। এর মধ্যে নিজ থেকে মামার চিৎকার শুনলাম। “পুলিশ এসেছে, বাড়িতে ঢুকতে চায়, গেটের তালা খুলতে বলে।” আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। নিচে মামা দাঁড়িয়ে। আমি পুলিশ অফিসারকে বললাম, “আব্বা অনেক রাতে ঘুমিয়েছেন। এখন রাত দেড়টা বাজে, এখন কি করে ডাকব? তা ছাড়া সকালের আগে কি করে বন্দি করবেন? আপনারা অপেক্ষা করুন।” আমি তাদের গেটের বাইরে চেয়ার দিয়ে বসতে বললাম। এবং তখন কিছুতেই ডাকতে পারবে না সে কথা জানালাম। আমি বারান্দা থেকে ঘর পেরিয়ে মাঝের বসার ঘরে বসে শুনি টেলিফোনে ওপার থেকে কে কি বলছেন না শোনা গেলেও আব্বাকে বলতে শুনলাম, “তোমাকে যখন নিতে এসেছে, তবে তো আমাকেও নিতে আসবে।” আমি জানালার পাশ থেকে বললাম, “নিতে আসবে না আব্বা, এসে গেছে অনেক আগে”। আব্বা উঠে দরজা খুললেন। ততক্ষণে বাড়ির সবাই জেগে গেছে। রাসেল খুবই ছোট, শুধু ও-ই ঘুমিয়ে আছে। দোতলায় চায়ের ঘরে গিয়ে কেটলিতে চায়ের পানি চাপালাম। চোখের পানি বাধ মানে না। চোখের পানি চেপে রাখার জন্য প্রাণপনে চেষ্টার করছি, আর আব্বার কাপড় চোপড় গুছিয়ে দিচ্ছি। মা অনেকগুলো এরনমোর তামাকের কৌটা দিলেন পরে পাঠাতে অসুবিধা হত। লেখার জন্য কাগজ, কলম, খাতা, কিছু বইপত্র এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী গুছিয়ে দিলেন। আব্বাকে ওরা নিয়ে গেল। ছোট রাসেল অবুঝ, অঘোরে ঘুমুচ্ছে কিছুই বুঝবে না, জানবে না। সকাল হয়ে গেল, পড়াশনা আর হল না। মনে হল বাড়িটা বড় শূণ্য ফাঁকা। এতদিনের কর্মচাঞ্চল্য হঠাৎ করে যেন থেমে গেল। সারাটা দিন কারও খাওয়া দাওয়া হল না। আত্মীয় স্বজন যারা খবর পেল, দেখা করতে এল। আবার এতদিন যাদের দেখেছি চেনা মুখ, তার দেখা গেল না। তবে সুখ-দুঃখের সাথী যারা, তারা ঠিকই দেখা করল। একে একে আওয়ামী লীগের বহু নেতা কর্মীকে ওরা গ্রেফতার করল।
১৯৬১ সালে এই বাড়িটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কোনমতে তিনটা কামরা করে আমরা এসে উঠি। এরপর মা একটা একটার কামরা বাড়াতে থাকেন। এভাবে ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে দোতলা শেষ হয়। আমরা দোতলায় উঠে যাই। ছয় দফা দেবার পর কাজ কর্মও বেড়ে যায়। নিচতলাটা তখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই ব্যতিব্যস্ত। নিজে আব্বার শোবার কামরাটা লাইব্রেরি করা হয়। ড্রেসিং রুমে সাইক্লোস্টাইল মেশিন পাতা হয়। লাইব্রেরির কামরায় টাইপ রাইটার মেশিন। আব্বা আলফা ইনসিউরেন্স কো¤ক্সানিতে চাকরি নেন বন্দিখানা থেকে মুক্তি পাবার পর। তখন রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগের সব নেতা এবড়ো ছিলেন অর্থাৎ সক্রিয় রাজনীতিতে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তাই ছাত্রদের সংগঠিত করে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু করা হয়। আব্বা অবশ্য আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবদের বাড়ি বেড়াতে যেতেন বিভিন্ন জেলায়। সেখানে দলকে সংগঠিত করার কাজ ও আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য জেলা, মহকুমা, থানায় গোপন সেল গঠন করেন। দেশকে স্বাধীন করার জন্য প্রতি দলকে সুসংগঠিত করার কাজ গোপনে চলতে থাকে। ছাত্র ইউনিয়নের বহু নেতা এ বাড়িতে এসেছে গোপনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ নিতে ও আলোচনা করতে। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি আব্বাকে ডাকা জেলাখানা থেকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৮ জানুয়ারি আমরা জেলগেটে গিয়ে আব্বার দেখা পেলাম না। কোথায় নিয়ে গেছে, বেঁচে আছেন কি না কিছুই জানি না। ছোট রাসেল, অবুঝ, কিছুই বুঝে না, ‘আব্বা আব্বা’ করে কেবল কাঁদে। জেলগেট থেকে ফিরে এসে এই বাড়ির মেেেঝতে গড়িয়ে আমরাও অনেক কেদেছি। এরপর শুরু হল মিথ্যা মামলা, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, আব্বাকে ফাঁসি দেবার ষড়যন্ত্র। গর্জে উঠল বাংলার মানুষ, শুরু হল আন্দোলন, গণ অভ্যুত্থান। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্র“য়ারি জনগণের চাপে আব্বাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হল ষড়যন্ত্রকারীরা। সেদিন এই বাড়ির সামনে মানুষের ঢল নেমেছিল। সমস্ত বাড়িই যেন জনতার দখলে চলে যায়। ১৯৭১ সালেল ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন মিছিলের পর মিছিল আসতে থাকে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় সব শ্রেণী, সব পেশার মানুষ এসে আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে যেত। আব্বা কখনো গেটের পাশে চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে, কখনো বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতেন। আমরা আব্বার পাশে এসে দাঁড়াতাম, হাজার হাজার মানুষের ঢল নামত তখন এই বাড়ির সামনে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গুলির আঘাতে ঝাঝরা হয়েছিল এই বাড়িটি। রাত ১২-৩০ মিনিটে আব্বা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বার নির্দেশ দিলেন। আর সেই খবর ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামে পৌছে দেয়া হল পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী। এই খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতারা তা প্রচার শুরু করলেন। যে মুহুর্তে এই খবর পাকিস্তানী সেনাদলের হাতে পৌছল, তারা আক্রমণ করল এই বাড়িটিকে। রাত ১-৩০ মিনিটে এসে আব্বাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। আজও মনে পড়ে সেই স্মৃতি। লাইব্রেরি ঘরের দক্ষিণের যে দরজা, তারই পাশে টেলিফোন সেটটি ছিল, ঐ জায়গায় দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
২৬ মার্চ পুনরায় এই বাড়ি পাকিস্তানী বাহিনী আক্রমণ করে। মা, রাসেল, জামাল ও কামাল কোন মতে দেয়াল টপকিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাড়িতে ঢুকে লুটতরাজ শুরু করে। প্রতিটি ঘর তারা লুট করে, ভাঙচুর করে। বাথরুমের বেসিন, কমোড, আয়না সব ভেঙে ফেলে। কয়েকজন সেনা বাড়িতে থেকে যায় দীর্ঘ নয় মাস ধরে বাড়ি লুট হতে থাকে। পাকসেনারা এক গ্র“পি লুট করে যাবার পর আর গ্র“প আসত। সোনাদানা জিনিসপত্র সবই নিয়েছে। আমরা এক কাপড়ে সব বেরিয়ে গিয়েছিলাম।
ছয় দফা দেবার পর অনেক সোনা রূপার নৌকা, ছয় দফার প্রতীক দলের পক্ষ থেকে আব্বাকে দেয়া হয়েছিল। সেগুলো আমার ঘরেই স্টীলের আলমারিতে রাখা ছিল। সব লুট করে নিয়ে যায় পাক সেনারা। যাক, ও সবের জন্য আফসোস নেই, আফসোস হল বই নিয়ে। আব্বার বহু পুরনো কিছু বইপত্র ছিল। জেলখানায় বই দিলে সেগুলো সেন্সর করে সিল গালা করে রাখ। ১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন, কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল, যা সব সময় আব্বার সঙ্গে যেত। জেলখানার বই বেশির ভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন আব্বা। কিন্তু আমার মা’র অনুরোধ এই বই ক’টা আব্বা কখনো দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র রচনাবলী, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বানার্ডশ, রাসেল, শেলি ও কীটসসহ বেশ কয়েকখানা বই। এর মধ্যে কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল মারা হয়। পরপর আব্বা কতবার জেলে গেলেন তার সিল এই বইগুলোতে ছিল। মা স্মৃতি বিজরিত এই বইগুলি খুব যতœ করে রাখতেন। আব্বা জেল থেকে ঝাড়া পেলেই খোজ নিতেন বইগুলো এনেছেন কি না, যদিও আব্বাকে অনেক অনেক বই জেলে পাঠাতে হত। মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন। নিউ মার্কেটের মা’র সঙ্গে আমরাও যেতাম। বই পছন্দ করতাম, নিজেরাও কিনতাম। সব সময়ই বই কেনা ও পড়ার একটা রেওয়াজ আমাদের বাসায় ছিল। প্রচুর বই, সেই বইগুলো ওরা নষ্ট করেছে। বইয়ের প্রতিও ওদের আক্রোশ কম ছিল না। আমার খুবই কষ্ট হয় ঐ বইগুলোর জন্য। ঐতিহাসিক দলিল হয়ে ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের তার সবই হারালাম।
১৯৮১ সালে আমি ফিরে এসে বাড়িটি খুলে দিতে বলি, কিন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমান অনুমতি দেননি। এমনকি বাড়িতে প্রবেশ করার অনুমতিও পাননি। মিলাদ পড়ানোর জন্যও বাড়ির দরজা জিয়াউর রহমান খুলে দেননি। রাস্তার উপর বসে আমরা মিলাদ পড়ি। জেনারেল জিয়া সরকারের পক্ষ থেকে থাকার জন্য আমাকে বাড়ি দেবার প্রস্তাব পাঠানো হয়। আমি একজন স্বৈরশাসকের হাত থেকে কিছু নিতে অস্বীকার করি। আমাদের দেশে প্রচলিত নিয়ম আছে প্রয়াত রাষ্ট্রপতির পরিবারকে ইট বাড়ী, একটি ফোন, ভাতা, গাড়ি ইত্যাদি সুযোগ সুবিধা রাষ্ট্র দিয়ে থাকে (যেমন জে. এরশাদের কাছ থেকে জেনারেল জিয়ার স্ত্রী ও পরিবার গ্রহণ করেছেন)। আমরা কোনদিনই কোন কিছুই গ্রহণ করিনি। জেনারেল জিয়া নিহত হবার পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাত্তার এই বাড়ির দরজা খুলে দেন। দেশে যখন আবার মার্শাল ল জারি হয়, এই বাড়িটি বিরোধী দলের জন্য নিরাপদ আশ্রয় ছিল যদিও দোতলা বা সিড়ি আমরা ব্যবহার করিনি কখনো। কেবলমাত্র শোবার ঘর আর লাইব্রেরি ঘরটা ব্যবহার করেছি। এ-ঘরে অনেক বৈঠক করা হত। ১৯৮৩ সালের ২১ জানুয়ারি মার্শাল ল’র বিরুদ্ধে আমি এই বাড়ির চত্বরে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনার নীরব সাক্ষী। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়ন, পরিকল্পনা গ্রহণসহ বহু ঘটনা এই বাড়িতে ঘটেছে। আবার ১৯৯০ সালের ২৭৪ নভেম্বর এরশাদ আমাকে এখানেই গ্রেফতার করে রাখেন। ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন পর্যন্ত এই বাড়িতে গৃহবন্দি হিসেবে অবস্থান করে আমি রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাই। এই বাড়িটি যখন ১২ জুন ১৯৮১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাত্তার সাহেবের নির্দেশে খুলে দেয়া হল, তখন চারপাশে গাছপালা বেড়ে জঙ্গল হয়ে আছে। মাকড়সার জাল, ধুলোবালি, পোকামাকড়ে সারা বাড়ি ভরা। ঘরগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন। গুলির আঘাতে লাইব্রেরি ঘরের দরজা ভাঙ্গা, বইয়ের আলমারিতে গুলির দাগ, কাচ ভাঙা, বইগুলো বুলেটবিদ্ধ, কয়েকটা বিথরে এখনও বুলেট রয়েছে। একটা বইয়ের নাম শ্রদ্ধাঞ্জলি, বইটির উপরে কবি নজরুলের ছবি, বইটির ভিতরে একখানা আলগা ছবি একজন মুক্তিযোদ্ধার, বুলেটের আঘাতে বইটি ক্ষতবিক্ষত। মুক্তিযোদ্ধার ছবিটির বুকের উপর গুলি। ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ সালে এ বাড়িতে যে আক্রমণ হয়, তা হল ১৯৭১ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ। বইটির তাকালেই যেন এব পরিস্কার হয়ে যায়। কেন ওরা হত্যা করল বঙ্গবন্ধুকে। মায়ের ঘরের আলমারির সব জিনিস বিছানার উপর স্তুপ করা। ঘরের মেঝেতে বড় বড় গুলির আঘাত। দোতলায় মা’র শোবার ঘর। এই ঘরেই খুকী, রোজী, জামাল, রাসেলকে খুনিরা হত্যা করেছ। মা দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাকে ওখানে গুলি করেছে। আব্বার বিছানার পাশের টেবিলটায় রক্তের ছোপ গোছা, গোছা চুলসহ লেগে আছে। এই ঘরেই হত্যাকারীরা ঐ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। তারপর দুহাতে লুটপাট করেছে। দোতলায় সিড়িতে এখনো রক্তের দাগ রয়েছে। দোতলায় জামালের ঘরের বাথরুমের বড় আয়নায় গুলির আগাতে বড় একটা গর্ত হয়ে আছে। দোতলার বসার ঘরের পশ্চিম পাশের ঘরটা বাড়ার ঘরের মতো, এখানে ইস্ত্রি করার টেবিলটার পাশে ডিনার ওয়াগান, কাচের ও রূপার জিনিসপত্র ভরা। উত্তর দিকে একটা শেলফ, যেখানে মায়ের হাতের আচারের বয়ামগুলো। এখনো সেই আচারের ঘ্রাণ রয়েছে। একটা টিনে কিছু আতপ চাল ছিল, এতে বছর পরও তেমনই আছে। মিটসেফে সব জিনিসপত্র। পাশে একটা আলমারির ভিতরে তোয়ালে ও বিছানার চাঁদর থাকত, ঠিক সেভাবেই আছে। শুধু ঘরের মধ্যে মাটিতে স্তুপীকৃত কাপড় আর ধুলা। সেগুলোতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। এই ঘরে কেন এত রক্তমাখা কাপড়? জানি না সেদিন কি ঘটেছিল। ঐ খুনিরাই বলতে পারে, যাদের এতটুকু হাত কাপেনি এভাবে গুলি চালাতে। মা’র বিছানা ও বালিশ গুলিতে ঝাঝরা, জামালের ঘরের বিছানা ও বালিশ গুলির আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন। অনেক দুর্লভ ছবি, জরুরী কাগজপত্র, দলিল, ব্যাংকের চেকবই সব খুনিরা নিয়ে গেছে। ছবিগুলো সব নষ্ট করেছে, ছিড়ে পরবর্তী সময়ে পোকায় কেটেছে।
১৯৮৭ সালে জেনারেল এরশাদ আমাকে এই বাড়িতে গৃহবন্দি করে রেখেছিলেন। সমস্ত বাড়ির জিনিসপত্র ১২ বছরে একদম নষ্ট হয়ে যায়। কারণ খুনিরা শুধুমাত্র হত্যাকাণ্ড করেই ক্ষান্ত হয়নি। হত্যার পর লুটপাটের চিহ্ন বেশী। মা’র ঘরের আলমারির সমস্ত কাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র বিছানার উপর ছড়ানো। তোশক বালিশগুলোর একদিকে বুলেটে ঝাঝরা, আবার অনেকগুলো বালিশ ছেড়া। দীর্ঘদিনের অযতেœর ফলে মাকড়শা’র জাল, পোকা ও ধুলায় সব নষ্ট হয়ে গেছে। আব্বা ও মা’র ঘরে পাশে যে ড্রেসিংরুম, তার আলমারিতে যে সব কাপড় ছিল, সব দলা করে রাখা ও পোকায় খাওয়া। মনে হয় যেন আলমারি খুব ঘাটাঘাটি করেছে। কেন? অনেক মুল্যবান জিনিসপত্র খুনিরা নিয়ে গেছে। মেঝে ভরতি পুরু ময়লা, পোকামাকড়, আরশোলা। সমস্ত ঘর ও আলমারিতে উঁইপোকা। সব কিছুর উপর দিয়ে কি যে ঝড় বয়ে গেছে, তা ভাষায় বর্ণনা করে বোঝাবার শক্তি আমার নেই।
এই ঘরবাড়ির সর্বত্র আমার মায়ের হাতের ছোয়া। কিন্তু দস্যুদানবের হাতে সব আজ এলোমোলো হয়ে ছড়ানো ছিটানো। সর্বত্র মনে হয় নারকীয় পিশাচের হিংস্র উল্লাস ও লুন্ঠনের স্পর্শ। এই বাড়িতেই আমি বন্দি। ধুলায় জমে যতই দিন যাচ্ছে, ততই নষ্ট হচ্ছে। বাড়িটাকে একদিন মিউজিয়াম করব, তার আগে পরিস্কার করা দরকার, মনকে শক্ত করা অত্যন্ত কঠিন। জিনিসপত্রগুলোতে হাত দেয়া কি যে বেদনাদায়ক, তা লিখে বোঝানো যায় না। শুধু যারা এভাবে সব হারিয়েছেন, তারাই হয়তো বুঝতে পারবেন।
আমার মাত অত্যন্ত পরিপাটি গোছানো স্বাভাবের ছিলেন। প্রতিটি জিনিস অত্যন্ত সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখতেন। যেমন প্রয়োজনে সবকিছু হাতের কাছে পাওয়া যায়। শীতের কাপড় এক আলমারীতে গোছানো, গরমেরগুলো অন্য আলমারীতে। তেমনি আলনায় আটপৌররে কাপড়, স্যাণ্ডেল, জুতা পর্যন্ত সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতেন। মা যখন আলমারি খুলতেন, দারুণ কৌতুহল হত সবকিছু দেখার। অনেক সময় আমিও আলমারি খুলতাম, দারুণ কৌতুহল হত সবকিছু দেখার। মা যা যা বের করতে বলতেন, সেগুলো ছাড়া অন্য কিছুতেই হাত দিতাম না। তবে মা খুললেই হাত দিতে খুব ইচ্ছে হত, কিন্তু সব আবার গুছিয়ে রাখতে পারব না বলে হাত দেওয়া হত না। আমার মায়ের হাতের সেই সুন্দর গোছানো সবকিছু আজ দানব খুনিদের হাতে লণ্ডভন্ড হয়ে আছে। মনকে মানিয়ে এক সময় বালতি ভরতি পানি, সাবান কাপড় ঝাড়ূ, নিয়ে সব পরিস্কার করতে শুরু করলাম। এত ময়লা যে একটা ঘর পরিস্কার করতে দিনে পাঁচ ছয় ঘন্টা কাজ করেও পাঁচ ছয় দিন সময় লেগেছে। নিজের হাতে সব পরিস্কার করে আমার মা যেভাবে যে জিনিস যেখানে রাখতেন, ঠিক সেভাবে ও সেখানে রাখতে চেষ্টা করেছি। দু’হাতে ময়লা সাফ করেছি আর চোখের পানি ফেলেছি। শুধু মনে হয়েছে, এই জন্যই কি বেঁচে ছিলাম। কি দুর্ভাগ্য আমার সবাই চলে গেল, আমি হতভাগিনী শুধু চোখের জলে ভাসছি আর এই বেদনা যন্ত্রণা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে কষ্টে দম বন্ধ হয়ে যেত। তখন কাজ বন্ধ রেখে অনেকক্ষণ আকুল হয়ে কেঁদে নিতাম। আবার এক সময় মনকে শক্ত করতাম। একটা জিনিসকেও ওরা অক্ষত রেখে যায়নি। যা পেয়েছে লুট করেছে, যা রেখে গেছে ক্ষতবিক্ষত করে রেখে গেছে ফটোগুলো ছিঁড়েছে, কাগজপত্র ডায়েরি দলিলপত্র সব নষ্ট করেছে। যে ঘরে যত ধুলা ময়লা ছিল, কিছুই ফেলিনি বড় বড় পলিথিনের ব্যাগে ভরে রেখেছি। কেন যেন ফেলতে পারলাম না মনে হল যেন সব কিছু, সবাই ছিল, এই মাত্র বাইরে গেছে, আবার আসবে।
সবক’টা ঘরই আমি আগের মতো করে সাজাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। আমার মা যেটা যেখানে রাখতেন, ঐ ভাঙাচোরা জিনিসপত্র আবার সেইভাবে রাখতে চেষ্টা করেছি। আমর মায়ের মতো করে। যখনই কোন জিনিসে হাত দিয়েছি, বিশেষ করে মায়ের আলমারি খুলে গোছাতে গেছি, মনে হয়েছে, এইমাত্র বুঝি মা পাশে এসে দাঁড়াবেন, বকবেন, ঘাটাঘাটি করিসনে, গোছানো জিনিস নষ্ট হবে বলে সাবধান করবেন। পর মূহুর্তেই মনে হয়েছে, মা তো আমার নেই। সব আছে, এই ঘর এই বাড়ি মনে হয় মা’র নিঃশ্বাস যেন শুনতে পাই পাশ থেকে, তার মমতার স্পর্শ যেন অনুভব করি।
অনেক স্মৃতিভরা ৩২ নম্বর সড়কের এই বাড়িটি। বাড়িটি আর আমাদের নেই। ওটা এখন জনগণের। আমরা সন্তান হিসেবে তাঁকে যতটুকু পেয়েছি, এদেশের জনগণ তার থেকে অনেক বেশী পেয়েছে। জনগনের জন্য দান করে দিয়েছি। আমার আব্বা শুধু তো আমাদের ছিলেন না, তার থেকেও বেশী ছিলেন জনগনের। আমরা সন্তান হিসেবে তাঁকে যতটুকু পেয়েছি, এদেশের জনগণ তার থেকে অনেক বেশী পেয়েছে। জনগনের কল্যাণে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে জেলে কাটিয়েছেন জীবনের অধিকাংশ সময়। আমরা আর কতটুকু তাঁকে কাছে পেয়েছি। এই বাড়িটি এ স্মৃতিভার- এ ভার বইবার ক্ষমতা আমার নেই, রেহানারও নেই। তাই আমরা আনন্দিত আমাদের এই বাড়িটি জনগণের উদ্দেশ্যে দান করে দিতে পেরে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর করার পরিকল্পনা ছিল আমাদের দীর্ঘদিনের। আমরা আজ গৌরব বোধ করি, আমাদের বহু স্মৃতিবিজরিত এই বাড়িটি আজ বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির প্রিয় তীর্থস্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে।

1 টি মন্তব্য:

নামহীন বলেছেন...

শেখ হাসিনার খুবই আবেগ প্রবন, চোখে জল এসে যায়। কিন্তু দাদা লেখাটি কোথায় পেলেন তা তো জানান নি।