বুধবার, ১৯ আগস্ট, ২০০৯

সাংস্কৃতির রাজধানী থেকে লাশের নগরী

আবু বকর সিদ্দীক, সম্পাদক, দৈনিক সময়ের কাগজ

কুষ্টিয়া নিয়ে অনেক গর্ব। এ মাটির সন্তানদের আলাদা রকমের অহংকার। লালন, রবীন্দ্র, মীর মোশাররফ, কাঙাল হরিণাথ, বাঘা যতিন, কবি আজিজুর রহমানসহ হাজারো জ্ঞাণীর শিকড়-বাকড় এখানে। স্বাধীনতার প্রথম সূর্যদয়ের স্পর্শ নিয়ে আমরা বীরত্বের প্রমাণ দিয়েছি। পিতা ও পিতামহরা দেশপ্রেমের অগ্নিপুরুষ, আমরা গড়ার সৈনিক। দেশ ও বিশ্বজুড়ে কুষ্টিয়া কীর্তিমান উৎপাদনের, সম্মান অর্জনের শ্রেষ্ঠ ভূমি। এ মাটির গন্ধ শরীরে, আমারও গর্ব-অহংকার ---
প্রযুক্তির কল্যানে ফেসবুকের বন্ধুরা সচল। অধরা ইচ্ছেগুলো ভেসে আসে ইন্টারনেটে। ছোট হয়ে যায় পৃথিবী, হাতের মুঠোয় বন্ধুত্ব, সব খবর। কুষ্টিয়ার ঐতিহ্য নিয়ে তৈরী সাইটটি আমার ওয়েবে লিংক আছে। দেশের বাইরের বন্ধুরা ছবি দেখে, তথ্য জেনে প্রেমে পড়ে। সুযোগ পেলেই বাংলাদেশ, তারপর প্রিয় কুষ্টিয়ায় তাদের অহরহ আসার ইচ্ছে। কয়েকজন ঘুরেও গেছে। সময়ের কাগজের অনলাইন সংস্করণ থেকে এ সময়ের বিশ্রী খবরগুলো তারাও দেখেছে। পাতা জুড়ে কাটা মাথা, এখানে সেখানে এবড়ো থেবড়ো লাশ। পত্রিকার পাতায় রক্তের বমি, শুধু খুন আর খুন। এসবের মধ্যে আমাদের বসবাস, সাংবাদিকতা।
সুহৃদ বন্ধুরা উৎকন্ঠিত। ফেসবুক ও ইমেলে সতর্কবাণী। সাবধানে থেকো, নিজের প্রতি খেয়াল রেখ। বাবা মায়ের হাত ধরে এ মাটিতে হাটতে শিখেছি, প্রতিটি ইঞ্চিকণা মাটিতে আমার স্পর্শ। ভালোবাসার গভীরতা জেনেই তারা কুষ্টিয়াকে নিয়ে বিশেষ কিছু লেখেনি। কিন্তু বলতে ছাড়েনি আমার স্বদেশীরা। বাদ যায়নি কুষ্টিয়ার কয়েকজন কৃতি সন্তান। ঢাকায় তাদের বিলাসী জীবন। সামনে নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। রাজধানীর আড্ডার আসর থেকে আমি কুষ্টিয়ায়- ব্যাঙ্গ করে তারা দেশপ্রেম নিয়েই থাকতে বলেছে। কমেন্টস লেখার সুযোগ থাকায় তারা সর্বোচ্চ আঘাত করতে ছাড়েনি। অশ্লীল, তীর্যক এসব মন্তব্য দেহজুড়ে কিলবিল করে। প্রিয়তমা কুষ্টিয়ার উঠানে লাশের গন্ধ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কাটা মাথা।
অপু ভাই (কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রদলের সাবেক সফল সভাপতি, বর্তমানে লেখালেখি ও আইন পেশার সঙ্গে ঘর সংসার)। সময়ের কাগজের এলোমেলো অফিসে সময় দেয়। রাত গভীর হলেও ব্যাচেলর অপু ভাই ওঠে না। কিছু একটা লেখার জন্য তাড়া দেয়। লেখার জন্য সামনে লাশ, পুলিশের দিনরাত টহল, মানুষের আতংক এসব ছাড়া আর কিছ্ইু দেখি না। ফেসবুকের বন্ধুদের উত্তর লিখতে ইচ্ছে করে না। মেইলগুলো ওপেন করি ভয় নিয়ে।
লিখতে পরিবেশ লাগে। লাগে সুস্থ চিন্তা করার সুযোগ। অফিসে ও বাসায় ঘিরে থাকে মোবাইল ফোনের যন্ত্রনা। ইদানিং সবগুলো খবরই খারাপ খবর। প্রতিনিধিরা সবার আগে জানিয়ে বাহবা পেতে চায়। চরমপন্থীদের ঘর গেরস্থের খবর ছাপছি। শ্রমজীবি-গণবাহিনী মুখোমুখি। হত্যা মিশনের পুরো বর্ণনা। স্বজনেরা এ লেখা ভালো চোখে দেখছে না। পাঠক পড়ে খুশী হচ্ছে, আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে ভয় পাচ্ছে। কারণে-অকারণে খোঁজ নিচ্ছে। পরিচিতরা জানতে চাচ্ছে, আজ কি কোন মাথা পাওয়া গেছে? কয়টা ? কাল বিশেষ কি থাকছে?
সকাল-সন্ধ্যা এবং গভীর রাত জুড়ে স্বজনের আহাজারী। লাশ কাটা ঘরের দরজা খোলার অপেক্ষা। হাসপাতালে উৎসুক জনতার ছুটাছুটি। পুলিশের সাইরেন এবং মোবাইল ফোনে কাটা মাথার দেহ উদ্ধারের খবর। এসব নিয়ে ডুবে থাকা সময়ে কী লিখব তা ভেবে পাচ্ছি না। বুক ভরে শ্বাস নেবার জন্য গড়াই পাড়, খোলা মাঠ নিষিদ্ধ। সেখানে বাতাসে লাশের গন্ধ। সাংস্কৃতির রাজধানী কুষ্টিয়া এখন লাশের নগরী। টেবিল, চেয়ার আর গাছের সঙ্গে আমরাও অথর্ব, বাকহীন।

কোন মন্তব্য নেই: