মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট, ২০০৯

মৃত্যুপুরী কুষ্টিয়া : লাশের লম্বা মিছিল

(১৮ আগষ্ট দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ)

সাজ্জাদ রানা, কুষ্টিয়া
'রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্ক ভর করে। সকাল হলেই খবর আসে, আজ আবার মানুষের কাটা মুণ্ডু পাওয়া গেছে। সন্ধ্যার পর কোথাও আড্ডা জমে না। অন্ধকার নামলেই ঘরে ফেরার তাড়া। কোনোদিন ফিরতে দেরি হলে বাড়ির মানুষ অজানা আশঙ্কায় কাঠ হয়ে থাকে। এই এখন আমাদের কুষ্টিয়া। এই শহরে কীভাবে থাকি বলেন?'
'কেমন আছেন'_ সমকালের এ প্রশ্নটুকুর জবাবেই গড় গড় করে এতসব কথা বলে তবেই থামলেন কুষ্টিয়া আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা। নাম প্রকাশেও কুণ্ঠিত সরকারি দলের ওই নেতা জানালেন, পুরো শহরেই এখন বিরাজ করছে এক নজিরবিহীন নিরাপত্তাহীনতা।
গত এক সপ্তাহে ১০টি হত্যাকাণ্ড, এক মাসে ৫টি কাটা মুণ্ডু উদ্ধার, গ্রাম থেকে শুরু করে শহরতক গোপন সংগঠনগুলোর বেপরোয়া চাঁদাবাজির তথ্যই বলে দেয় আওয়ামী লীগ নেতার ওই আতঙ্ক কুষ্টিয়ার সব মানুষের মধ্যেই বিরাজমান। এক সময়ের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এখন দিনে দিনে হয়ে উঠছে ছিন্নমস্তক, আতঙ্ক আর মৃত্যুর শহর। চরমপন্থিদের পূর্ব বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার, হাটঘাট নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডারবাজিকে কেন্দ্র করে একের পর লাশ পড়ছে কুষ্টিয়ার মাটিতে।
মুখোমুখি সংগঠিত চরমপন্থিরা : গত কয়েক বছরে পুলিশ ও র‌্যাবের ক্রসফায়ারে জেলার ১৬৭ সন্ত্রাসী নিহত হওয়ার পর অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে চরমপন্থি সংগঠনগুলো। নিজের জীবন বাঁচাতে অনেকে গাঢাকা দেয় দেশ ও দেশের বাইরে। এলোমেলো হয়ে পড়ে দল। তবে এ সময় অনেক সন্ত্রাসী নিহত হলেও তাদের অস্ত্রভাণ্ডার রয়ে যায় সুরক্ষিত। সম্প্র্রতি আবার ফিরে আসছে চরমপন্থিরা। কুষ্টিয়ায় গণবাহিনী, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ও গণমুক্তিফৌজ আবার সক্রিয় হয়ে তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। ইতিমধ্যে একের পর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সবাই জানান দিচ্ছে তাদের অবস্থান। দলে শূন্যতা পূরণ করতে নতুন নতুন ছেলেদের দলে টানা হচ্ছে। তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে ভারী অস্ত্র। মাসিক বেতন দিয়ে তাদের পোষা হচ্ছে বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে। পূর্ব বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে চরমপন্থি সংগঠনগুলো এখন মুখোমুখি। প্রতিদিনই কুষ্টিয়া সদর, মিরপুর, ভেড়ামারা ও কুমারখালীর বিভিন্ন গ্রামে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ভারী অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। এমনকি কুষ্টিয়া শহরেও মহড়া দিচ্ছে তারা। মিরপুর উপজেলার আমলা, সদরপুরসহ আরও কয়েকটি এলাকায় প্রতি রাতে মহড়ার পাশাপাশি বোমার বিষ্ফোরণ ঘটাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। গত এক মাসে ৩৫টি বোমার বিষ্ফোরণ ঘটানো হয়েছে বলে এলাকাবাসী ও পুলিশ জানিয়েছে।
চাঁদার টাকায় অস্ত্র : কুষ্টিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদাবাজি বেড়েছে। মোবাইল ফোন ও চিরকুট পাঠিয়ে লোক মারফত এসব টাকা আদায় করা হচ্ছে। ঠিকাদার-ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কলেজ শিক্ষকদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় চলছে। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, নতুন অস্ত্র কেনা ও দলের ব্যয় মেটাতে চলছে এই জোর চাঁদা আদায়। গত এক সপ্তাহে কুষ্টিয়া শহরের দুই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা নিয়েছে একটি চরমপন্থি সংগঠনের সদস্যরা। এছাড়া মিরপুর ও ভেড়ামারা থেকেও চাঁদা নেওয়া হয়েছে ৫ ব্যবসায়ী ও এক ঠিকাদারের কাছ থেকে। সম্প্রতি গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল শহরে অভিযান চালিয়ে অত্যাধুনিক ৫টি অস্ত্র উদ্ধার করে। এসব অস্ত্র চাঁদার টাকা দিয়েই কেনা হয় বলে গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বেপরোয়া চাঁদাবাজির কারণে ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীরা প্রাণের মায়ায় নিজের এলাকা ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছেন। সমকালের অনুসন্ধানে এমন দু'জন ঠিকাদারের সন্ধান মিলেছে। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে তাদের একজন জানান, দুই দফায় দেড় লাখ টাকা চাঁদা দিয়েও পরের দফায় আবার 'চাঁদা নইলে প্রাণ' এমন হুমকিতে তিনি বাধ্য হয়েছেন এলাকা ছাড়তে। মিরপুর উপজেলার হালসা গ্রামের ঠিকাদার শেখ আহমেদ সম্প্রতি একই কারণে গ্রাম ছেড়েছেন। তিনি বলেন, 'চাঁদার টাকা দিতে না পারলে মৃত্যু নিশ্চিত। সে কারণেই এলাকা ছেড়েছি।'
বিদেশ থেকে ফিরছে সন্ত্রাসীরা : কুষ্টিয়ার মিরপুর এলাকার ৪ শীর্ষ চরমপস্থি গত কয়েক সপ্তাহ আগে এলাকায় ফিরেছে। মিরপুর থানা পুলিশের তালিকাভুক্ত এসব সন্ত্রাসী এলাকায় ফিরেই আবার শুরু করেছে নানা অপকর্ম। মিরপুর থানার একজন সহকারী পুলিশ পরিদর্শক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, উপজেলার হালসার নগরবাঁকা গ্রামের জমির বাহিনীর প্রধান আমজান কুয়েত থেকে এলাকায় ফিরেছে। একাধিক মামলার আসামি কুর্শা ইউনিয়নের ইশালমারী গ্রামের সন্ত্রাসী জহুরুল সম্প্রতি এলাকায় ফিরে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। দুবাই থেকে ফেরত আসা ইবি থানার পাটিকাবাড়ী ইউনিয়নের ডাবিরাভিটা গ্রামের সন্ত্রাসী নাসির পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। এছাড়া জেল থেকে বের হয়ে সিরাজ বাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান মিরপুর উপজেলার আমবাড়িয়া গ্রামের হানা, ইখলাস, সিরাজের ছোট ভাই রেজাউলসহ আরও কয়েকজন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এখন তৎপর। মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি কেবল বলেন, 'পুলিশ তৎপর রয়েছে। দ্রুত এসব সন্ত্রাসীকে আটক করা হবে।'
রাজনীতিবিদরাও আতঙ্কিত : একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জেলার সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গত মাসে কুমারখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক কয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামিল হোসেন বাচ্চুকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ১৫ আগস্ট রাতে ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মেহেরুল আলমকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে সন্ত্রাসীরা। গুরুতর আহত মেহেরুল এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছেন। বিএনপির অনেক নেতার কাছেও চাঁদা চেয়ে হুমকি দিচ্ছে সন্ত্রাসীরা।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বলেন, 'রাজনীতিবিদদের ওপর নানাভাবে আঘাত আসছে। বিএনপির কিছু লোকজন ও পুলিশের কতিপয় সদস্য আওয়ামী লীগ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এরাই চরমপন্থিদের সঙ্গে আঁতাত করে জেলায় হত্যাসহ নানা অপকর্মে মেতে উঠেছে।'
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মিনহাজুর রহমান আলো বলেন, 'চরমপন্থি অধ্যুষিত কুষ্টিয়ায় আবার ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দলের অনেক নেতাকেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে।' তিনি অভিযোগ করেন, সরকারি দলের কয়েকজন নেতার প্রশ্রয়েই এমনটি ঘটছে।
অসহায় পুলিশ : সমকালের সঙ্গে আলাপকালে জেলার পুলিশ কর্মকর্তারা অকপটে স্বীকার করেছেন তাদের অসহায়ত্বের কথা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলার এক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, 'আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠনের আধিপত্য রয়েছে এমন অন্য এলাকার সঙ্গে তুলনা করলে কুষ্টিয়ার বিষয়টি একেবারেই আলাদা। এখানে ওইসব দলের প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে সব মহলের যোগাযোগ ভালো। এ কারণে অনেক সময় তথ্যও পাচার হয়ে যায়। এখানে ছোটখাটো অনেক ঘটনার সঙ্গে ওইসব দলের লোকজন যুক্ত থাকে। ফলে খুব ছোট ঘটনাও বড় হয়ে ওঠে।' তিনি স্বীকার করেন, এই জেলায় সন্ত্রাসীদের হালনাগাদ তথ্য না থাকার বিষয়টি তাদের ভোগাচ্ছে। কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার সাহাবুদ্দিন খান বিপিএম এ প্রসঙ্গে বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা উদ্বেগজনক। তবে পুলিশ তৎপর রয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বড় সফলতা আসতে পারে।'

কোন মন্তব্য নেই: