শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০০৯

জাতীয় শোক দিবস



১৫ আগষ্ট। জাতীয় শোক দিবস। বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে কলংকের কালিমালিপ্ত একটি দিন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি ও মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট কালো রাতে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য নির্মমভাবে হত্যা করে। সেই সর্বনাশা রাতের দৃশ্যপট মানসচক্ষে একবার ভেসে উঠলেই শিহরিত হতে হয়। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে জাতির জনকের রক্তাক্ত মৃতদেহ। বাড়ির অন্যত্র ছড়ানো-ছিটানো বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, তার স্ত্রী সুলতানা কামাল, অপর পুত্র শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজী জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, ভাই শেখ নাসের ও কর্ণেল জামিলের নিথর মৃতদেহ। অন্য বাড়িতে শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, শিশু বাবু, আরিফ, রিন্টু খানসহ অনেকের লাশ। এ যেন ছিল খুনিদের অদম্য রক্ত পিপাসা ।
বাংলাদেশের হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত দেশপ্রেমে যার মন-প্রাণ সিক্ত ছিল, পরাধীনতার গোলামির জিঞ্জির ভেঙ্গে যিনি হাজার বছরের নিপীড়িত, নিগৃহীত, বঞ্চিত বাঙ্গালি জাতির জন্য স্বাধীন আবাসভূমি সৃষ্টির লক্ষ্যে জীবনজয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়কালকে উৎসর্গ করলেন ইতিহাসের সেই মহিমান্বিত মহাপুরুষের প্রাণসংহার করলো স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক চক্র ।
আজ জাতীয় শোক দিবস। বঙ্গবন্ধুর ৩৪তম শাহাদাৎ বাষিকী। শোকাবহ এ দিনটিতে জাতি-ধর্ম-দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ জাতির জনকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও সমবেদনা জ্ঞাপন করবে। মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডায় মহান নেতার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে ভক্ত, শুভানুধ্যায়ী, আত্মীয়-পরিজন, কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ মানুষ আজ প্রার্থনার আয়োজন করবে, জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। আজ সরকারি ছুটির দিন ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নাম, একটি ইতিহাস। বাঙ্গালির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি। তার জীবন ছিল সংগ্রামমুখর। সংগ্রামের মধ্যেই তিনি বড় হয়েছিলেন। তার জন্ম তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়ায়। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠনে বঙ্গবন্ধু সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে মহানায়ক হিসাবে ’৭০-এর নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগকে এদেশের গণমানুষের আশা-আকাঙক্ষার প্রতীকে পরিণত করেন। অবিসংবাদিত এই নেতার জীবন চলার পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলে ’৬০-এর দশক থেকেই তিনি বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়কে পরিণত হন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ কয়েক লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে ঢাকার তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বজ্রদৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তারই বজ্র নির্ঘোষ ঘোষণায় উদ্দীপ্ত, উজ্জীবিত জাতি স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ধারণ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
ইতিহাসের এই মহানায়কের উদ্দেশে কবি লিখেছিলেন, “যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান”। জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদর বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। তখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে পুনর্গঠনের কাজটি ছিল ব্যয়সাপেক্ষ, দুরূহ ও দীর্ঘমেয়াদী। তার নেতৃত্বে যখন সেই কাজটি চলছিল ঠিক তখনই শুরু হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিক পরিণতিতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। বিদেশে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রোহানা।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করে দেয়া হয়। একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি বাতিলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার কার্য শুরুর পথ প্রশস্ত করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারকার্য। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন এবং দিবসটি সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করে। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়ত জোট ক্ষমতায় আসার পর এক নির্বাহী আদেশে জাতীয় শোক দিবসের সরকারি ছুটি বাতিল করে।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ ও বিচারপতি মোঃ আশফাকুল ইসলাম গত বছর ২৭ জুলাই এক রায়ে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন ও সরকারি ছুটি বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তকে বেআইনি ও অবৈধ ঘোষণা করেন। পরে ১০ আগস্ট বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকরের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বহাল করা হয় সরকারি ছুটি।
এবার ১৫ আগষ্ট পালিত হচ্ছে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে । ৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর প্রথম নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন। চলছে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত ,আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার লড়াই। আজ সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের হোক দীপ্ত শপথ।

কোন মন্তব্য নেই: